ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ৩১ মার্চ ২০২৫, ১৭ চৈত্র ১৪৩১

ঈদ সামনে রেখে টাকা তোলা হচ্ছে রাজনৈতিক পরিচয়ে

মার্কেট ফুটপাত পরিবহনে নীরব চাঁদাবাজি

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২৩:৩৪, ২৮ মার্চ ২০২৫

মার্কেট ফুটপাত পরিবহনে নীরব চাঁদাবাজি

চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছেই

চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছেই। ৫ আগস্টের পর ওপেন চাঁদাবাজি করা হলেও ঈদ আসতেই সিক্রেটে পরিণত হয়েছে। নীরবে মার্কেট, শপিংমল, ফুটপাত, পরিবহন খাত এমনকি বাসা-বাড়ি ও মহল্লাভেদে চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে নাম আসছে সেই পুরোনো লোকদের। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিচয়ে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।

অবশ্যই এক্ষেত্রে চাঁদাবাজ ও ব্যবসায়ী বা উভয়পক্ষই লাভবান থাকেন কোনো না কোনোভাবে। ফলে পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগ করেন না, আবার পুলিশ জানতে চাইলেও কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছে না। এরপরও পুলিশ চাঁদাবাজদের ঠেকাতে তৎপর রয়েছে। 
রাজধানীর চাঁদনী চক মার্কেটে ১২ শতাধিক দোকান রয়েছে। ঈদ ঘিরে এই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কৌশলে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের বিরুদ্ধে। বিভিন্ন মহলকে ম্যানেজ করার কথা বলে বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে। আদৌ বিভিন্ন মহলের নাম করে নেওয়া বাড়তি টাকা সেই খাতে দেওয়া হবে নাকি কমিটি আত্মসাৎ করবে, সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে ব্যবসায়ীদের। তাই সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যবসায়ী সমিতি এই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করে খাবে। 
এই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানান, বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে দোকান প্রতি ৭০০ টাকা নেওয়া হচ্ছে। বিনিময়ে কোনো চাঁদাবাজ দোকান মালিকদের কাছে চাঁদা চাইবে না বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি বলেন, বিগত বছরগুলোতে ৩০০-৫০০ টাকা নেওয়া হতো। গতবছরও ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। এ বছর ৭০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে ঈদ উৎসব খরচ বলা হচ্ছে। কেউ যদি তাদেরকে এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলে। তখন স্টাফ বেতনসহ বিভিন্ন খরচ সামনে আনা হয়। মূলত এটি ঈদের চাঁদা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদনী চক বিজনেস ফোরাম ও চাঁদনী চক বনিক সমিতি দুটি সংগঠন রয়েছে মার্কেটটিতে। আগে বিজনেস ফোরামের আওয়ামী নেতারা এই চাঁদা নিতেন। পটপরিবর্তনের পর ওই নেতারা দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ায় নতুন নেতৃত্বে এসেছে। ফলে বনিক সমিতির নির্দেশে বিদ্যুৎ বিলের রশিদের সঙ্গে ঈদ উৎসব ভাতা তোলা হচ্ছে। 
জানতে চাইলে চাঁদনী চক বিজনেস ফোরামের সভাপতি মো. নিজাম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ঈদে মার্কেটের স্টাফদের বোনাস দিতে হয়। আনুষাঙ্গিক অনেক খরচ আছে। এসব বাবদ একটা বাড়তি টাকা নেওয়া হয়। এছাড়া অন্য কিছু নয়।  
ওই এলাকায় অবস্থিত দেশের সর্ববৃহৎ বইয়ের মার্কেট। যা নীলক্ষেত বইয়ের মার্কেট নামে পরিচিত। ঈদ ঘিরে এই মার্কেটের দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি বলেন, তার কাছ থেকে নিউমার্কেট ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতা পাঁচ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছেন।

অন্যান্য দোকানিদের কাছ থেকেও বিভিন্ন খরচের কথা বলে এই টাকা রেডি করে রাখতে বলেছেন। ঈদের ২-১ দিন আগে নিতে আসবেন। তবে ভয়ে বিএনপির ওই নেতার নাম প্রকাশ করেননি একাধিক দোকানি। 
নিউমার্কেট এলাকার গাউছিয়া মার্কেট, এলিফ্যান্ড রোড, ধানম-ি হকার্সসহ অন্যান্য মার্কেট থেকেও ঈদের বিভিন্ন খরচের নামে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে অন্যান্য বছর বহিরাগত লোকজন হুমকি-ধামকি দিয়ে চাঁদা আদায় করলেও এবার হয় কমিটি না হয় বিভিন্ন কৌশলে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এই এলাকার হাজার হাজার ফুটপাতের দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অথচ এত চাঁদাবাজির একটিরও তথ্য জানেন না পুলিশ। পুলিশের কাছে কেউ অভিযোগও করে না। 
জানতে চাইলে নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহসীন উদ্দিন বলেন, চাঁদাবাজি নিয়ে তো কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। মামলা, লিখিত অভিযোগ কিংবা মৌখিক কোনো অভিযোগই তারা পাননি। তিনি বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর যার যে অভিযোগ, মামলা সবই নিয়েছি। তাই এই এলাকার চাঁদাবাজিসহ অন্যান্য অপকর্মের সঙ্গে জড়িত যারা ছিল তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ফলে ওই এলাকায় চাঁদাবাজির কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছে না। 
খোঁজ নিয়ে উত্তরার আজমপুর এলাকার ফুটপাত, মিরপুরের বিভিন্ন মার্কেট, ৬০ ফিট রোডের বিভিন্ন দোকানে, বায়তুল মোকাররম মার্কেট, গুলিস্তান, শান্তিনগর, মতিঝিল ও পল্টনের বিভিন্ন মার্কেটে নীরবে চাঁদাবাজির খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ৬০ ফিটে এক ব্যবসায়ী মিরপুর মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে। থানা পুলিশ, চাঁদা প্রতিরোধে ৬০ ফিটের সব ব্যবসায়ীকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দিয়েছে। এরপরও কোনো চাঁদাবাজ চাঁদা দাবি করলে তাকে আটকিয়ে থানায় খবর দিতে বলা হয়েছে। 
ঈদ বকশিসের নামে পরিবহন খাত থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরিবহন মালিক সমিতিও বিভিন্ন মহলে ঈদ সালামি দেওয়ার কথা বলে পরিবহন খাত থেকে চাঁদা আদায় করছে। এমনটি পরিবহন সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করলেও ভেতরগত কোনো তথ্য দিতে নারাজ তারা। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা বেশ বাড়তি টাকা আদায় করছে। 
২২ মার্চ কোতোয়ালি থানাধীন বাবুবাজার ব্রিজ এলাকায় বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা আদায়ের সময় আদায়কৃত টাকাসহ পারভেজ ও তছলিম নামে দুই চিহ্নিত চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ।
কোতোয়ালি থানা সূত্রে জানা যায়, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে ট্রাক স্ট্যান্ড এলাকায় কতিপয় চাঁদাবাজ ভয়-ভীতি দেখিয়ে কাভার্ড ভ্যান, ট্রাক, পিকআপ ও ভ্যান গাড়িসহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে অবৈধভাবে চাঁদা আদায় করত। ঈদ ঘিরে এর মাত্রা বেড়ে যায়। অবশেষে পুলিশ দু’জনকে গ্রেপ্তার করে। 
আজিমপুরের এক বাড়িওয়ালা অভিযোগ করেন, সেহরিতে এলাকার যুবকরা সেহরি খেতে ডেকে তুলেন। এ বাবদ তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা দাবি করছেন। ওই বাড়িওয়ালার অভিযোগ, কয়েকজন যুবক টাকা নির্ধারণ করে দেয়। এর কম দিলে টাকা নেওয়া হবে না এবং সমস্যা হবে বলে হুমকি দেয়। কিন্তু সেহরিতে ডেকে দেওয়া সওয়াবের কাজ। এ কাজ করে তারা এখন টাকার পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া তো চাঁদার শামিল। ওই যুবকরা স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানান এই ব্যক্তি। 
থেমে নেই পুরো রাজধানীর ফুটপাত থেকে চাঁদাবাজি। গুলিস্তান, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, নিউমার্কেটসহ সব এলাকার ফুটপাতে চাঁদাবাজি হচ্ছে ঈদ ঘিরে। অথচ রোজার আগেও ওইসব এলাকার হকারদের কেউ বিরক্ত করতেন না। ঈদে খরচের নামে স্থানীয় নেতারা চাঁদা দাবি করেন। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কুয়েত মৈত্রী হলের সামনে থেকে আজিমপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এবং বিএনপির কয়েকজন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চাঁদা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। 
৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ওপেন চাঁদাবাজিতে পরিণত হয়েছে। ছাত্র-সমন্বয়ক পরিচয়ে বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করা হতো। এতে আত্মরক্ষার্তে চাঁদা দিতে বাধ্য হতেন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। বিগত সরকারের লোক আখ্যা দিয়ে এভাবে চাঁদা আদায় করা হতো।

গত ৮ মার্চ কলাবাগান থানা এলাকায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হামলা ও লুটের অভিযোগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ১৪ সমন্বয়ককে আটক করেছে যৌথবাহিনী। এর আগেও রাজধানীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-সমন্বয়ক পরিচয়ে জিম্মি করে চাঁদা আদায় করা হয়েছে। 
এমন ঘটনার পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। যৌথবাহিনী চাঁদাবাজির অভিযোগ পেলেই অভিযান পরিচালনা করতে থাকে। 
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তথ্যানুযায়ী, গত পাঁচ মাসে চাঁদাবাজির ঘটনায় ডিএমপির ৫০টি থানায় ২৭৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৫৪ জন চাঁদাবাজকে। এরমধ্যে গতবছরের অক্টোবর মাসে মামলা হয়েছে ৪৯টি, গ্রেপ্তার ২৮ জন। নভেম্বর মাসে মামলা হয়েছে ৩২টি, গ্রেপ্তার ১৭ জন। ডিসেম্বর মাসে মোট মামলা ৫৩টি। আর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৪ জনকে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৯০টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৩ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৫ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮২ জনকে। 
এরমধ্যে থেমে নেই চাঁদাবাজি। গত ২৪ মার্চ মোহাম্মদপুরের টাউন হলের শের শাহ শুরী রোডে ৭৫/বি নম্বর এক ব্যবসায়ীর অফিসে ঢুকে চাঁদা চেয়ে প্রকাশ্যে গুলি চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। 
হ্নভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মনির হোসেন জানান, চারদিন আগে একটি বিদেশী নাম্বার থেকে বার্তা আদান-প্রদানের প্ল্যাটফর্ম হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তাকে ফোন দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন ঈমন পরিচয়ে তার কাছে ঈদের সালামি চায়। এর চারদিন পর একদল সন্ত্রাসী তার অফিসে এসে প্রকাশ্যে গুলি করে।
হ্নওই বাড়ির কেয়ারটেকার জেহাদুল ইসলাম জানান, ইফতারের পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে মোটরসাইকেলে করে তিনজন লোক আসেন। এরমধ্যে একজন মোটরসাইকেলের ওপর বসে থাকে। বাকি দু’জন অফিসে প্রবেশ করেই বলে ক্যাপ্টেন ইমনের সঙ্গে যোগাযোগ করস না ক্যান। এরপরেই বন্দুক বের করে দুই রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে তারা। 
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, রোজার শুরু থেকেই চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশি টহল ও প্যাট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে। রাজধানীর ৫০টি থানাতেই কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে অক্সিলারি ফোর্স নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে এ বছর এখন পর্যন্ত আমরা চাঁদাবাজদের উৎপাতের খবর পাইনি।

ঈদের আর মাত্র অল্প কিছুদিন বাকি। এই সময়ে কেউ চাঁদাবাজির চেষ্টা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আর কেউ চাঁদা দাবি করলে তা সঙ্গে সঙ্গে থানা পুলিশকে অবহিত করার পরামর্শ দেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।

×