
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলায় টুপি তৈরির কাজে ব্যস্ত নারীরা
ঈদকে সামনে রেখে টুপি তৈরিতে ব্যস্ত রংপুরের একদল নারী শ্রমিক। তবে, এই টুপি আর দশটি সাধারণ টুপির মতো নয়। এর বিশেষত্ব হলো, এটি ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। এতে করে গ্রামের হতদরিদ্র প্রায় ৫ হাজার নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের খোপাতি গ্রামের হাফেজ আবদুল আউয়াল (৫৫)। চাকরি করতেন সিলেট টেক্সটাইল জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে। পরে বদলি হয়ে চলে আসেন কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলে। এরপর ২০০২ সালে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী বাধ্যতামূলক অবসরে যান।
অবসর নেওয়ার পর প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা পান। ভাবেন, যে টাকাগুলো রয়েছে তা দিয়ে এমন কিছু করবেন যাতে নিজে এবং সমাজের অবহেলিত মানুষও উপকৃত হয়। এ সময় তিনি জানতে পারেন তাদেরই গ্রামের পাশে ফেনী ও নোয়াখালী থেকে এসে টুপি বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে।
২০০৫ সালে পূর্ব পরিচিত এক লোকের মাধ্যমে ফেনি চলে যান। সেখান গিয়ে ব্যবসায়ী আবুল খায়েরের কাছে দুই মাস টুপি বানানোর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর সেখান থেকে ৩০০ পিস টুপি বানানোর কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসেন বাড়িতে। নিজে এবং বাড়ির পাশের কয়েক নারীকে সঙ্গে নিয়ে সেগুলোর কাজ শেষ করে আবার তা ফেনীতে দিয়ে যান। কাজ দেখে আবুল খায়ের খুশি হন। এ জন্য প্রতিটি টুপি তৈরি বাবদ তাকে দেওয়া হয় ৫০০ টাকা। যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে প্রতি টুপিতে তার লাভ থাকে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এভাবে শুরু হয় তার ব্যবসা।
অবসর ও জমি বন্ধকের প্রায় ৫ লাখ টাকা দিয়ে কিনে ফেলেন মোটরচালিত ৫০টি সেলাই মেশিন। সেই মেশিন দিয়ে চলে টুপি সেলাই ও অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ। কাউনিয়ার বালাপাড়াতে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে করেন অফিস ও কারখানা। ফ্যাক্টরির নাম দেন ‘এম এইচ টুপি’ কারখানা। ধীরে ধীরে ব্যবসা প্রসারিত হতে থাকে। এখন শুধু কাউনিয়া উপজেলায় নয়, রংপুর সদর, লালমনিরহাটের তিস্তাচর, কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন গ্রামের মহিলারা টুপি বানিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করেছেন।
এর মধ্যে কাউনিয়া উপজেলার খোপাতি, পূর্বচানঘাট, চানঘাট, বলভবিষু, ভূতছাড়া, সাবদি, হরিশ্বর, পাজরভাঙ্গা, গদাই, তালুকশাহবাজ, নিজপাড়া, মধুপুর, কুফিরপাড়, ভায়ারহাট, শিবু, কুড়িগ্রামের উলিপুর, রাজারহাট, লালমনিরহাট সদর এবং রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নব্দিগঞ্জ, ইটাকুমারীর হাসনা গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার নারী এ কাজে যুক্ত আছেন।
কাউনিয়া উপজেলার হরিশ্বর গ্রামের তহুরা বেগমের দুই ছেলে এক মেয়ে। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। সংসারে জমি জিরাত বলতে শুধু ৪ শতক ভিটা। তহুরা জানান, তার স্বামী মারা যাওয়ার পর খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে কেটেছে সংসার।
এরপর হাফেজ আউয়ালের টুপি তৈরির কারখানায় দেড় মাস প্রশিক্ষণ নেন। শুরু করেন টুপি বানানোর কাজ। তিনি বলেন, এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না, সংসার ভালোই চলছে। মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় হয় তার।
কলেজ শিক্ষার্থী শারমিন বলেন, এইচএসসিতে পড়ার সময় টাকার অভাবে আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়। তখন থেকে টুপি তৈরির কাজ করে লেখাপড়ার খরচ চালাই, বাবা-মাকেও কিছু সংসার খরচ দেই।
কথা হয় এম এইচ টুপি কারখানার সুপারভাইজার খোরশেদ আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরে আমরা নারীদের সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। নকশা হয়ে গেলে তা আবার ফেরত নিয়ে আসি টাকা দিয়ে। এতে আমরা প্রতি টুপি বাবদ ৩০ টাকা পাই।
কথা হয় মাহমুদিয়া হস্তশিল্প টুপি (এম এইচ টুপি) কারখানার মালিক হাফেজ আব্দুল আউয়ালের ছেলে মাহামুদুল হাসানের সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবা ব্যবসার কারণে বেশিরভাগ সময় ওমান থাকেন। পবিত্র রমজানকে লক্ষ্য করে কোরবানির ঈদ পর্যন্ত বিক্রি বাড়ানোর জন্য তিনি এখন ওমানে আছেন। সেখানকার ব্যবসায়ী সেলিম মিয়ার সঙ্গে তাদের এক বছর আগে চুক্তি হয়। তখন থেকে সরাসরি তারা নিজেরাই ওমানে টুপি রপ্তানি করছেন। তিনি জানান, এখন সপ্তাহে ৩৫০-৪০০ টুপি তৈরি হচ্ছে। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে গেছে।
কাপড়, বহন খরচ, বিদ্যুৎ, মজুরিসহ অন্যান্য খরচ মিলে একটি টুপিতে তার খরচ পড়ছে ৫০০-৫১৫ টাকা। ওমান পৌঁছানো পর্যন্ত খরচ পরে ৬০০-৬১৫ টাকা। ওই টুপি তিনি বিক্রি করেন ৭০০-৭৫০ টাকা। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি টুপিতে তার ৮০-১০০ টাকা লাভ থাকছে। মাসে ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টুপি রপ্তানি করা হচ্ছে। যা থেকে মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। তবে সব মাসেই তার আয় এক রকম থাকে না।
তিনি জানান, টুপিতে উন্নত মানের কাপড়ের ওপর বাহারি সুতার কাজ করা হয়। ফলে, কারুকার্য বেশি হওয়ায় টুপির দাম একটু বেশি পড়ে। এসব বানানো টুপি আমাদের দেশে বিক্রি হয় না। বিদেশী ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই রপ্তানিযোগ্য করে এসব টুপি তৈরি করা হয়।
কাউনিয়া বালাপাড়া ইউনিয়ন চেয়ারম্যান আনছার আলী জানান, সরকারি সহায়তা পেলে এই টুপি কারখানায় অনেক মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতো।