ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ মার্চ ২০২৫, ১৫ চৈত্র ১৪৩১

সন্জীদা খাতুনকে অশ্রুসিক্ত শ্রদ্ধা

জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’

মনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ০০:০৪, ২৭ মার্চ ২০২৫

জীবনমরণের সীমানা ছাড়ায়ে’

ছায়ানট প্রাঙ্গণে সনজীদা খাতুনকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা নিবেদন

জীবনভর অশুভের বিরুদ্ধে উচ্চারণ করেছেন শান্তি ও কল্যাণের বাণী। সুরকে হাতিয়ার করে লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। মানবিক ও মুক্ত সমাজ বিনির্মাণে রেখেছেন অনন্য ভূমিকা। সংস্কৃতিকে সঙ্গী করে দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। সম্প্রীতি ও প্রগতির দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে কেটে গেছে গোটা এক জীবন। সেই মহিয়সী নারী ও সংস্কৃতি সংগ্রামী সন্জীদা খাতুনকে নিবেদন করা হলো বিদায়ী শ্রদ্ধাঞ্জলি। চোখের জলের সঙ্গে গানের সুরে নিবেদিত হলো তার প্রতি অপার অনুরাগ।

প্রকাশিত হলো অশেষ ভালোবাসা। বুধবার এই শিল্প-সংস্কৃতির দিশারী, সংগঠক, গবেষক, সংগীতজ্ঞ, শিল্পী, শিক্ষক ও গবেষককে তিন দফা শ্রদ্ধা জানানো হয়। শুরুটা হয় তারই গড়া বাঙালি সংস্কৃতির আত্মপরিচয়ের স্মারক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট থেকে। এর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো হয়। সবশেষে শবদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শাহবাগের বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের হিমাগারে।

সন্জীদা খাতুনের নাতি-নাতনিরা দেশে আসার পর সমাহিত করার বিষয়ে পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। মঙ্গলবার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান সন্জীদা খাতুন। তার বয়স হয়েছিল ৯১ বছর।
বুধবার বেলা ১২টার কিছুক্ষণ পর সন্জীদা খাতুনের শবদেহ প্রথম নিয়ে যাওয়া হয় ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে। মরদেহ রাখা হয় ছায়ানটের নিচতলার প্রশস্ত বারান্দায়। তার আগে থেকেই শ্রদ্ধা নিবেদনে ফুল হাতে দীর্ঘ সারিবদ্ধ মানুষের দেখা মেলে ছায়ানটের প্রবেশপথে। অনেকের চোখে ছিল জল, মুখাবয়বে ছিল বাঙালিত্বের পথের দিশারী প্রিয়জনকে হারানোর বেদনার্ত অভিব্যক্তি।

সেখানে সমবেত হয়েছিলেন কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, নির্মাতা, কবি-সাহিত্যিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ।  মরদেহ ছায়ানটে নিয়ে আসার পর গোলাপ, বেলিসহ নানা রঙের পুষ্প ও ফুলের তোড়ায় ঢেকে যায় কফিন। এ সময় বেজে ওঠে সন্্জীদা খাতুনের গাওয়া ধারণকৃত গান ‘ঝরা পাতা গো, আমি তোমারই দলে’। এভাবেই জীবন থেকে ঝরে যাওয়া সন্জীদা খাতুনকে গানে গানে ভালোবাসা জানিয়েছেন ছায়ানটের শিল্পী ও শিক্ষার্থীসহ অনুরাগীরা। ভবনের প্রথম তলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত দেখা গেছে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদনে সমবেত মানুষের সারি।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ থেকে ফকির লালন সাঁইয়ের এশ্বর্যময় সৃষ্টির সুরে সন্জীদা খাতুনকে জানানো হয়েছে বিদায়ী ভালোবাসা। গাওয়া হয়েছে ‘তুমি যে সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলে’, ‘জীবনমরনে সীমানা ছাড়ায়ে’, ‘মারের সাগর পাড়ি দেব’ ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’ ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি’সহ একগুচ্ছ গান।  এ সময় খ্যাতিমান শিল্পীদের মধ্যে কণ্ঠ মেলান খুরশীদ আলম, বুলবুল ইসলাম, শারমীন সাথী ময়না, লিলি ইসলাম, রোকাই হাসিনা নীলিসহ অনেকে। তাদের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়েছেন সন্জীদা খাতুনের মেয়ে রুচিরা তাবাসসুম।  
সন্জীদা খাতুনের বর্ণিল জীবনের মূল্যায়নে ছায়ানটের সহসভাপতি এবং লেখক ও গবেষক মফিদুল হক বলেন, তার জীবনটাই ছিল যেন এ দীর্ঘ অভিযাত্রা। সেই অভিযাত্রায় সংগীতের মাঝে প্রাণের স্ফূরণ ও জীবনের অর্থময়তার সন্ধান করেছেন। উল্টোদিকে বাঙালিত্বের আত্মপরিচয়ের সকল অনুষঙ্গকে ধারণ করেছেন। সে কারণেই তিনি ছায়ানটকে শুধু একটি প্রতিষ্ঠান নয় বাঙালির জীবনের দর্শনের শিক্ষালয়ে পরিণত করেছেন। অসংখ্য শিক্ষার্থীকে মানবতার দীক্ষা দিয়েছেন।

ছায়ানটের মাধ্যমেই ষাটের দশকে শুরু হওয়া বাংলা নববর্ষের ছোট্ট আয়োজনটিকে জাতীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সব মিলিয়ে তিনি বাঙালিত্বের গৌরব এবং বাঙালির গর্ব। তিনি বাঙালি জাতির শক্তিময়তার প্রতীক। পরিণত হয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার প্রতীকে। বন্যা, খরাসহ দেশের যেকোনো আন্দোলন বা সংগ্রামে রেখেছেন স্বকীয় ভূমিকা। 
নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, সন্জীদা খাতুন এক বর্ণাঢ্য জীবন কাটিয়েছেন। শুদ্ধসংগীতের প্রসারে সারাদেশে কাজ করেছেন। অসংখ্য মানুষের মধ্যে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করেছেন। যারা তার সংস্পর্শে এসেছেন, তারা আলোকিত হয়েছেন।
আরেক নাট্যজন ম. হামিদ বলেন, সংস্কৃতির আশ্রয়ে সন্জীদা খাতুন মানবিকতার বিকাশ ঘটিয়ে মূল্যবোধ জাগ্রত করার দীক্ষা দিয়েছেন। শিখিয়েছেন দেশ ও নিজের সংস্কৃতিকে ভালোবাসতে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে প্রকৃত বাঙালি হওয়া শিখিয়েছেন।
সন্জীদা খাতুনের কোমলতা ও দৃঢ়তার বিষয়টি তুলে ধরে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক এবং পুত্রবধূ লাইসা আহমদ লিসা বলেন, বাইরে থেকে তাকে খুব কঠিন মানুষ মনে হয়। তবে তার ভেতরটা ছিল খুবই কোমল। এজন্য তাকে খুশি করাও খুব সহজ ছিল। ভেতর ভেতরে প্রচ- ¯েœহপ্রবণ একটা মন ছিল তার। তাই শাশুড়ির পরিবর্তে তার কাছ থেকে মায়ের ভালোবাসাটাই পেয়েছি। উল্টোদিকে সাংগঠনিক যেকোনো সংকটে তার সঠিক নির্দেশনা পেয়েছি। এই ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন এক মানুষ।

বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আমরা তার সেই সংগ্রামী রূপটি দেখেছি। ব্যক্তি জীবনের সুখের দিকে না তাকিয়ে সমাজের কল্যাণে নিজের জীবনকে বিলিয়ে গেছেন। সংস্কৃতিচর্চার মাধ্যমে মানুষ গড়া ও দেশপ্রেমের দীক্ষা দিয়েছেন তার সান্নিধ্যপ্রাপ্তদের।  
প্রখ্যাত অভিনয়শিল্পী তারিক আনাম খান বলেন, সন্্জীদা খাতুনকে অনুসরণ করেই আমরা শিল্প-সংস্কৃতির পথ চিনেছি। শিল্পকে নিছক বিনোদনের বাইরে সমাজ পরিবর্তনের দর্শন হিসেবে ভাবতে শিখেছি। শিল্পের আলোয় সত্য ও ন্যায়ের পথ চিনেছি। এ কারণেই তিনি এদেশের সংস্কৃতি ভুবনের পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব।   
সাবেক সংসদ সদস্য ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নাতনী আরমা বলেন, সন্জীদা খাতুন বাঙালি সংস্কৃতির জন্য আজন্ম কাজ করেছেন। তিনি সারা পৃথিবীতেই বাঙালিকে উঁচু স্থানে নিয়ে যেতে কাজ করেছেন। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পথ ধরে তিনি আলো বিলিয়েছেন। সেই আলোয় আমরা আলোকিত হয়েছি।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, পরিপূর্ণ এক সফল জীবনকে আলিঙ্গন করেছেন সন্জীদা খাতুন।    
সন্্জীদা খাতুনের দাফনের বিষয়ে তার ছেলে পার্থ তানভীর নভেদ বলেন, তিনি দেহদানের ইচ্ছা প্রকাশ করে গেছেন। তবেই এটি কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়। তার নাতি-নাতনিরা দেশের বাইরে থেকে এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে যে তাকে সমাহিত করা হবে নাকি দেহদান করা হবে।  
ছায়ানটে সাংগঠনিকভাবে ফুলেল শ্রদ্ধা জানিয়েছে রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ, কণ্ঠশীলন, সুরের ধারা, বাংলা একাডেমি, গ্রাম থিয়েটার, ঢাকা থিয়েটার, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, চিত্রশিল্পী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক অধ্যাপক আবুল বারক্্ আলভী, চলচ্চিত্র শিক্ষক মানজারে হাসিন মুরাদ, নজরুলসংগীত শিল্পী শাহীন সামাদ, নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক, রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অদিতি মহসিন, বুলবুল ইসলাম, নৃত্যশিল্পী শামীম আরা নীপা, আবৃত্তিশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, অধ্যাপক শফি আহমেদ, নাট্য নির্দেশক নায়লা আজাদ নূপুর, কণ্ঠশিল্পী চন্দনা মজুমদার, লোক গবেষক সাইমন জাকারিয়া, অভিনয়শিল্পী ত্রপা মজুমদার প্রমুখ।
দুপুর ১টার দিকে সন্জীদা খাতুনের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের বাংলা বিভাগে। তিনি এই বিভাগে দীর্ঘদিন অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন। এখানে তাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান, বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক সৈয়দ আজিজুল হক, আখতার কামাল, কবি দিলারা হাফিজ প্রমুখ। 
বেলা আড়াইটায় মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। এখানে শ্রদ্ধাঞ্জলির তত্ত্বাবধান করেন খ্যাতিমান অভিনেতা ঝুনা চৌধুরী, গণসংগীত সংগঠন সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট ও আবৃত্তিশিল্পী রফিকুল ইসলাম। 
সন্জীদা খাতুনের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স। তিনি বলেন, সন্জীদা খাতুন নিজেই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। এদেশে সকল রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যাদের ভূমিকা রয়েছে তাদের মধ্যে তিনি একজন। আমৃত্যু মানবতাবাদী ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে কাজ করেছেন। সংস্কৃতিক আশ্রয়ে মানবিক জীবন দর্শনকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

তবে তিনি কোনো প্রাপ্তির আশায় কাজ করেননি। বরং নিজেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই সন্জীদা খাতুনের মতো মানুষের মৃত্যুতে রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক জানানো না হলে সেটা রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। রাষ্ট্র তাকে মনে না রাখলেও তিনি বেঁচে থাকবেন এদেশের মানুষের হৃদয়ে। বেঁচে থাকবেন আপন কাজ ও দর্শনের মাঝে। 
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, অভিনেতা শংকর সাঁওজাল, অভিনেত্রী ও নির্মাতা আফসানা মিমি, নৃত্যশিল্পী ওয়ার্দার রিহাব ও তামান্না রহমান প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানায় শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ।

×