ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

এক গাছে দুই সবজি

রঙিন ক্যানভাসের মতো বাগান, ঝুলে আছে মনলোভা টমালু

মাহমুদুল আলম নয়ন

প্রকাশিত: ০০:৩২, ২৬ মার্চ ২০২৫

রঙিন ক্যানভাসের মতো বাগান, ঝুলে আছে মনলোভা টমালু

টমালু আবাদে বগুড়ায় মাঠ পর্যায়ে সফলতা

সবুজের মধ্যে লাল আর হলুুদাভ ছোপ ছোপ রং ছড়ানো টমেটো ঝুলে থাকায় রঙিন ক্যানভাসের মতো বাগান। মনোলোভা টমেটো ঝুলে রয়েছে  থোকা থোকা বাগানে। কোনোটা লাল আবার কোনোটা গাঢ় লাল বর্ণ ধারণ করার আগে হলুদাভ। তবে দেখে এটি টমেটোর বাগান বা খেত মনে হলেও মোটেও তা একেবারে সত্য বলা হবে না। কারণ একের ভিতর দুই।

একই গাছে দুই সবজি। ওপরে টমেটো আর নিচে আলু। দুটিই স্বতন্ত্র সবজি হলেও এটি কিন্তু সোলানেসি গোত্রের উদ্ভিদ। আর যেহেতু একই গাছে দুই ধরনের সবজির ফলন তাই কৃষি বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন টমালু বা টম আলু। দীর্ঘদিন ধরে দেশে এই টম আলুর চাষ নিয়ে কাজ চললেও এখনো কৃষক পর্যায়ে পৌঁছায়নি তা। এবার বগুড়ায় এক কৃষি উদ্যোক্তা তার এ্যাগ্রো ফার্মে টমালু চাষে সফলতা পেয়েছেন। এখন তাদের লক্ষ্য আগামী বছর থেকে কৃষক বা মাঠ পর্যায়ে এটি ছড়িয়ে দেওয়া। যদিও এখনো কিছু কাজ বাকি রয়েছে বলে কৃষি উদ্যোক্তা রুবেল মিয়া জানান। 
টমালু নিয়ে দেশে কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শেরেবাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে। অন্যান্য বিশ^বিদ্যালয়েও বেসরকারি পর্যায়েও এ নিয়ে কাজ হয়েছে। জোড়কলম বা গ্রাফটিং পদ্ধতিতে এর আবাদ হয়। আলু গাছের চারার ওপর অংশ কেটে সেখানে টমেটোর চারা গ্রাফটিং করে লাগিয়ে ফলাতে হয় সবজি। এই গাছে ওপরের অংশ সাধারণ টমেটোর মতোই ফলন তবে গাছের নিচের অংশেই রয়েছে চমকপ্রদ।

সেখানে আবার সাধারণ আলু  খেতের গাছের মতো মাটির নিচে ফলছে আলু। আর একই গাছে দু’ধরনের ফলন যেমন ব্যয় সাশ্রয়ী তেমনি আবার পৃথক কোনো জমি ব্যবহার না করেই একই জমিতে দু’ধরনের সবজি পাওয়া যাচ্ছে। এতে টমেটো ও সবজি আবাদের ক্ষেত্রে আরও বেশি ফলন পাওয়ার নতুন সম্ভাবনার সুযোগ তৈরি করছে। বগুড়ার কৃষি উদ্যোক্তা রুবেল মিয়া, যিনি আবার চাকরিও করেন কৃষি বিভাগে। চাকরি পাওয়ার আগে থেকেই কৃষির সঙ্গে তার ছিল অদৃশ্য টান।

লেখাপড়াও করেন কৃষি নিয়ে। লেখাপড়া শেষ উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হিসাবে কর্মরত। তবে কৃষি বিভাগে চাকরি পাওয়ার আগেই বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মুরাদপুরে ৫ বিঘা জমির ওপরে গড়েন কৃষিবন্ধু এ্যাগ্রো সার্ভিস নামে একটি প্রতিষ্ঠান। চাকরির কারণে এটি এখন শুধু তত্ত্বাবধান করেন। জানালেন এখানেই তিনি টম আলু নিয়ে ৩ বছর ধরে কাজ করছেন।

দীর্ঘদিন ধরে লেগে থাকার পর অবশেষে গত বছরের শেষে তিনি সফলতা পান। মাঠ পর্যায়ে ২ শতক জমিতে পরীক্ষামূলক আবাদ করেন টমালু। এখানে চারা লাগান ১ হাজার। সেসব গাছ থেকে সফলভাবে ফলন পাচ্ছেন এখন। এখন তার স্বপ্ন কৃষকদের মাঝে মাঠ পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়া। জানালেন এটি করতে বাড়তি কোনো ব্যয় হয় না। সব মিলিয়ে সাধারণ আলু চাষে যা খরচ তার চেয়ে খরচ সাশ্রয়ী হবে। কারণ একই ব্যয়ে দুই সবজি ফসল পাওয়া যাচ্ছে একই জমি থেকে। এক ফসল করলে 
আরেক ফসলের জন্য যেমন জমির চিন্তার প্রয়োজন নেই। তেমনি দুই ফসল ফলানোর কারনে হয়ে উঠছে ব্যয় সাশ্রয়ী। শীতকালীন আবাদ বলে ঘন কুয়াশার কারণে আলু খেতে লেটব্লাইট রোগের আক্রমনের ভয় থাকে বেশি। তবে টমালুর ক্ষেত্রে তা নেই বলেই জানান কৃষি উদ্যোক্তা রুবেল মিয়া। তার বক্তব্যে যেহেতু আলু চারার ওপরের অংশ কেটে গ্রাফটিং করে টমেটো চারা লাগিয়ে আবাদ করা হচ্ছে, সে কারণে ওপরের অংশ আর আলু গাছ থাকছে না।

একারণে আলু খেতে যে কারনে বার বার কীটনাশক স্প্রে করতে হয়, টমালুর আবাদে তা লাগছে না বলে অনেক কম রাসায়নিক এতে ব্যবহার হচ্ছে। এতে যেমন খরচ যেমন কমছে তেমনি উৎপাদিত আলু ও টমেটো নিরাপদ হয়ে উঠছে। টমালুর একটি গাছ থেকে সাধারণ ক্ষেতের মতোই ১ কেজির বেশি আলু পাওয়া যাচ্ছে। আর টমেটো পাওয়া যাচ্ছে প্রতি গাছে ৩/৪ কেজি পর্যন্ত। একটি টমেটো গাছ ৩ থেকে ৪ মাস পর্যন্ত ফলনে থাকে। আর আলু আবাদ হয়ে ৮০ দিনে।

টমেটো গাছ থাকায় আলু একই গাছে দু দফা উত্তোলন করা যায়। প্রথমে মাটি সরিয়ে বড় আলু। পরের দফায় আবার আলু তোলার উপযোগী সময় হলে গাছের একেবারে নিচের ছোট আলু অনেক বড় হয়ে যায়। ফলে এটি অনেক ব্যয় সাশ্রয়ী আবাদ বলে জানান রুবেল মিয়া। তবে টমালুর ক্ষেত্রে আলু গাছের সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে বাঁশের পাতলা খুঁিট দিতে হয়। সাধারণ আলু ক্ষেতে যার প্রয়োজন না থাকলেও টমালুর ক্ষেতে টমেটোর ভার সহ্য করার জন্য এটি দিতে হয়।

এই একটি খরচ সাধারণ আলু ক্ষেতের চেয়ে বেশি। টমালু চাষের বিষয়ে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হান্নান জানান এই সবজি মৌসুমে আগাম করলে কৃষকদের জন্য লাভবান হবে। বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্রশিক্ষন কর্মকর্তা একেএম মফিদুল ইসলাম জানান, এটি দেশে একটি নতুন কৃষি প্রযুক্তি। মাঠ পর্যায়ে বগুড়াতে শিবগঞ্জেই প্রথম চাষ হচ্ছে।  এটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এর সফলতা আসলে কৃষক পর্যায়ে তা সম্প্রসারণ করা হবে।

×