ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৯ মার্চ ২০২৫, ১৫ চৈত্র ১৪৩১

কলাপাড়ার টাইগার চিংড়ি

চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে গরিব মানুষের কর্মসংস্থান

মেজবাহউদ্দিন মাননু

প্রকাশিত: ০০:১৩, ২৫ মার্চ ২০২৫

চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে গরিব মানুষের কর্মসংস্থান

কলাপাড়ায় বাছাই করে মাথা আলাদা করা হচ্ছে টাইগার চিংড়ির

দেখতে অবিকল ছোট বাগদা চিংড়ির মতো। কিন্তু বাগদা চিংড়ি নয়। বাঘের চামড়ার মতো ডোরাকাটা। তাই বলা হয় টাইগার চিংড়ি। লালচে-খয়েরি রঙের। অনেক জেলে এ কারণে লাল চিংড়িও বলেন।  উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, টাইগার চিংড়ির বৈজ্ঞানিক নাম ‘মারসুপেনিয়াস জাপোনিকাস’।

এটি হচ্ছে মারসুপেনিয়াস গণভুক্ত চিংিড়ির একটি প্রজাতি। এটি কুরুমা চিংড়ি, জাপানি টাইগার চিংড়ি নামেও পরিচিত। টাইগার পুরুষ চিংড়ি লম্বায় ছয় থেকে সাড়ে ছয় ইঞ্চি, স্ত্রী চিংড়ি ১১ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে। ওজন ১৩০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। পাগুলো ফ্যাকাশে হলুদ রঙের থাকে। সাধারণত বেশিরভাগ সময় সমুদ্রের পানির ২০-৫০ মিটার গভীরতায় চলাচল করে টাইগার চিংড়ি।
 জেলেদের দাবি, সাগর কিংবা নদীতে পানি যখন লোনা থাকে তখন এই চিংিড়ির জন্ম হয়। আবার পানি মিঠা হলেই কমে যায়। অনেকের ভাষ্য, মরে যায়।  জেলেদের অনেকের মতে, মিঠা পানিতে গভীর সাগরে চলে যায়। ফিবছর শুধু কলাপাড়ায় আট-নয় কোটি টাকার টাইগার চিংড়ি বিক্রি হয়। এর বড় মোকাম উপজেলার মৎস্য বন্দর মহিপুর-আলীপুরে।

টাইগার চিংড়িকে ঘিরে চার/পাঁচ মাসের কর্মসংস্থান মেলে অন্তত আট-দশ হাজার জেলে পরিবারের। তাদের স্ত্রী-সন্তানদের কর্মসংস্থান হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভাষ্যমতে, টাইগার চিংিড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়। যা দিয়ে দেশে আয় হয় কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। তবে এখন স্থানীয় বাজারে এ চিংড়ির চাহিদা ব্যাপক। শহর, উপশহরসহ গ্রামীণ হাটবাজারে প্রতিদিন বিক্রি হয় টাইগার চিংড়ি। গ্রামীণ জনপদে ফেরি করেও এই চিংড়ি বিক্রি হয়।
সাগরপারের জনপদ কলাপাড়ার বৃহৎ মৎস্য বন্দর মহিপুর ও আলীপুরে এই চিংিড়ির সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা চলে। এর বাইরেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে বিক্রির আরও অসংখ্য স্পট। ি বছর কম করে হলেও ৪০০-৪৫০ টন টাইগার চিংড়ি এখান থেকে খুলনা ও ঢাকায় ট্রাক কিংবা পিকআপ বোঝাই করে চালান হয়। স্থানীয়দের দাবি, ‘বিদেশে এক্সপোর্ট হয় টাইগার চিংড়ি।’ দামও বেশ ভালো। সাগরে আহরিত টাইগার চিংড়ি প্রথমে মাথাসহ আড়তে বেচাকেনা হয়। কেজি ২০০-২৫০ টাকা।

তারপর মাথা আলাদা করে শুধু বডিসহ এ চিংড়ি রপ্তানিযোগ্য মানের করা হয়। তখন দাম হয় তিনগুণ। কখনো আরও বেশি। তবে এবছর এই চিংড়ির একটি বড় অংশ স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। মৌসুমে ১০-১২ হাজার মণ টাইগার চিংড়ি কলাপাড়ার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে চালান করা হয় বলে এখানকার মৎস্য আড়তদার সমিতি নেতৃবৃন্দের দাবি। বিগত বছরগুলোর হিসাব এটি।
মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাজু আহম্মেদ রাজা জানান, ফিবছর একেকটি ট্রলারের জেলেরা গড়ে ৪০০-৫০০ মণ টাইগার চিংড়ি মহিপুর-আলীপুরে বিক্রি করে। অন্তত ৪০টি ট্রলারের চিংড়ি শিকার করে জেলেরা। নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত টাইগার চিংড়ি ধরা পড়ে। বৃষ্টি শুরু হলে সাগর-নদীর পানি মিঠা হয়ে যায়। তখন আর এই চিংড়ি পাওয়া যায় না।

খাড়া এক ধরনের জাল ভাটার সময় সাগরে পেতে রাখা হয়। তখন চিংড়িগুলো জালে চাপে, জোয়ারের আগেই তুলতে হয়। নইলে সব ভেসে যায়। এজালে অন্য কোনো মাছ আটকায় না। তারপরও কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী ও মৎস্য বিভাগ এই জালও পুড়িয়ে ফেলে। সচেতন  জেলে ও আড়তমালিকদের ভাষ্য, সাগরের মাছ ও জাল সম্পর্কে তাদের  (কোস্ট গার্ড, নৌবাহিনী) পূর্ণ অভিজ্ঞতা নেই। যেন চলছে অনভিজ্ঞ শাসন।

কারণ লোনা পানিতে জন্ম নেওয়া এই চিংড়ি না ধরলেও মিঠা পানির মৌসুমে মারা যাবে, কমে যাবে। রাজু আহম্মেদ জানান, এ মাছ মাংসের মতো ভুনা করে খেতে খুব স্বাদ। বিশেষ করে চাইনিজ রেস্তোরাঁয় এই চিংড়ির কদর অনেক বেশি। আহরিত অর্ধেক টাইগার চিংড়ি বিদেশে রপ্তানি হয় বলে ব্যবসায়ীদের দাবি।
স্থানীয়ভাবে সাগর কিংবা মোহনা এলাকায় নির্দিষ্ট জাল পেতে জেলেরা টাইগার চিংড়ি আহরণ করে। আড়তে বিক্রির পরে চিংড়ির মাথা বডি থেকে আলাদা করা হয়। এ জন্য শ্রম দেয় জেলে পরিবারের দরিদ্র মহিলা, শিশু ও জেলে শ্রমিকরা। মৌসুমের প্রায় চার-মাস প্রতিসপ্তাহে ৩/৪দিন এসব মানুষের কাজ জোটে টাইগার চিংড়িকে কেন্দ্র করে। ৭০০-৮০০ দরিদ্র নারী-পুরুষ পায় চিংড়ির মাথা ছাড়ানোর কাজ। এর সঙ্গে জড়িতরা এ কাজকে বলেন চিংড়ির মাথা ভাঙ্গার কাজ।

তবে অনেক জেলে, আড়তমালিক ও শ্রমিকের ভাষ্য, ‘চিংড়ি হেডলেস’ করার কাজ। এক কেজি চিংড়ির মাথা ভেঙ্গে মজুরি মেলে মাত্র তিন থেকে সর্বোচ্চ দশ টাকা। অথচ কাজটি খুবই দুরূহ। জড়িত শ্রমিকরা জানান, মাথা ভাঙ্গার কাজে অনেকের আঙ্গুলে ঘা হয়ে যায়। ক্ষতস্থান থেকে অনেক সময় রক্ত ঝরতে থাকে। বহুদিন রাত দুইটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়।
মহিপুর ফেরিঘাট থেকে সোজা ডানদিকে শিববাড়িয়া নদীর পাড় ঘেঁষে আড়তের সামনে খালি জায়গায় এ মৌসুমে প্রতিদিন শতাধিক নারী-পুরুষ-শিশু টাইগার চিংড়ির মাথা ভাঙ্গার কাজ করে থাকে। মহিপুর থেকে খালগোড়া পর্যন্ত গেলে চোখে পড়ে টাইগার চিংড়ি কেন্দ্রিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড। ছড়ানো মাথা আবার শুঁটকি করে মাছের খাবারের ফিড তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। এ কারণে মাথাও বিক্রি হয়। মাথা ছড়ানো কাজের শ্রমিক হাবলু সরদার, সনিয়া বেগম, কাকলি বেগম জানান, তারা অধিকাংশই জেলে পরিবারের সদস্য। বহু শিশু-কিশোরও একাজ করছে।

তাদের দাবি টাইগার চিংড়ি ধরার কারণে তারা প্রায় পাঁচ মাসের কাজ পায়। তাদের কাছে এটি সিজনাল কাজ। শুধু কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর, আলীপুর, খালগোড়া, কাউয়ারচর, গঙ্গামতিসহ বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিবছর পাঁচ মাসে অন্তত আট-নয় কোটি টাকার টাইগার চিংড়ি বেচকেনা হয়। বিদেশে এই চিংড়ির চাহিদাও প্রচুর। এই চিংড়ি দেখতে অনেকটা আলাদা প্রজাতির মনে হয়। নাকে একটু গন্ধও লাগে।

হাজার হাজার জেলে পরিবারের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় এই টাইগার চিংড়ির বেচা-কেনাকে কেন্দ্র করে। অথচ সরকারিভাবে আলাদা কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি টাইগার চিংড়ি প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে। এজন্য চিংড়ি বাছাই কাজ করতে একটি শেড করা জরুরি প্রয়োজন। রপ্তানিযোগ্য এ চিংড়ির স্যুপ খুবই সুস্বাদু বলে দাবি আড়ত মালিকদের। বর্তমানে কলাপাড়ার বাজারে টাইগার চিংড়ি ফেরি করে বিক্রি করতেও দেখা যায়।
কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, কলাপাড়ার এই অঞ্চল থেকে তাদের হিসেবে প্রত্যেক মৌসুমে ৬৫-৭০ মেট্রিক টন চিংড়ি বেচাকেনা হয়। এই চিংড়িসহ শুঁটকি প্রসেসিংয়ের কাজে জেলে জনগোষ্ঠীর সুবিধা ও সহায়তার জন্য খালগোড়ায় ১৪ একর খাস জমির দুই একর জমিতে পোস্ট হার্ভেস্ট সেন্টার করতে একটি প্রস্তাবনা দেওয়া আছে। এটি বাস্তবায়ন হলে জেলেসহ শ্রমিকদের কাজে অনেক সহায়তা হবে।

×