ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৬ মার্চ ২০২৫, ১২ চৈত্র ১৪৩১

দীর্ঘদিনের লজ্জা থেকে রক্ষা পেলাম ॥ প্রধান উপদেষ্টা

সন্দ্বীপে শুরু হলো ফেরিসেবা স্বপ্ন পূরণে আনন্দের জোয়ার

স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ২৪ মার্চ ২০২৫

সন্দ্বীপে শুরু হলো ফেরিসেবা স্বপ্ন পূরণে আনন্দের জোয়ার

সন্দ্বীপ নৌ-রুটে সোমবার আনন্দমুখর পরিবেশে শুরু হয় ফেরি সার্ভিস

সাগরবক্ষের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকা সন্দ্বীপে শুরু হলো ফেরি সেবা। সমুদ্রপথে দেশের প্রথম ফেরি সার্ভিস চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ রুট। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ঘাটে এ ফেরি সেবার বর্ণাঢ্য উদ্বোধন করেন নৌ পরিবহন এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণায়য়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। দ্বীপবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ও আকাক্সক্ষা পূরণ হওয়ায় সন্দ্বীপে আনন্দের জোয়ার বইছে। 
ফেরি সেবার কারণে কাদামাটি মাড়িয়ে এবং জীবন ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার ভোগান্তি থেকে রেহাই পেল উপজেলাবাসী। ফেরি সেবার উদ্বোধনের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। 
নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া পর্যন্ত চলাচল করবে এই ফেরি।  সোমবার সকাল ৯টায় প্রথমবারের মত সন্দ্বীপের উদ্দেশে এই ফেরি যাত্রা করে। ফেরি সেবা চালু করতে সন্দ্বীপ এবং চট্টগ্রামের বাঁশবাড়িয়ায় নতুন সড়ক, পার্কিং ও ফেরিঘাট নির্মাণ করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের আগে হয়েছে পরীক্ষামূলক চলাচল। এর আগে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিলেও তা সম্ভব হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করায় সন্দ্বীপের বাসিন্দারাও খুব খুশি।
মূল ভূখ-ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন এ দ্বীপে একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌযান। প্রায় চার লাখ মানুষের সন্দ্বীপে আসা-যাওয়ার ভরসা ছিল সাগরপথ। দ্রুত যোগাযোগের জন্য মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোটে সাগর পাড়ি দিত। সকলের দাবি ছিল ফেরি সেবার। কিন্তু বিগত কোনো সরকার এ সেবার ব্যবস্থা করেনি। যার ফলে উপেক্ষিত ছিল সন্দ্বীপের মানুষের দাবি। ফলে দ্বীপের মানুষেরা স্পিডবোট ও ট্রলারসহ বিভিন্ন নৌযানে চলাচল করত। এছাড়া বৈরী আবহাওয়ার কারণে সন্দ্বীপে নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যেত এসব কারণে অসুস্থ রোগীকে জরুরি চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম আনতে না পেরে মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে সন্দ্বীপে।

এছাড়া সমুদ্র পাড়ি দিয়ে গভীর রাতে প্রসূতিসহ উন্নত চিকিৎসার জন্য অসুস্থ রোগীদের মূল ভূখ-ে আনা যেত না। সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে অনেক নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে। ফেরির কারণে সাগরবক্ষের এই দ্বীপের সঙ্গে মূল ভূখ-ের সরাসরি যোগাযোগের বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্ন পূরণ হলো। এখন চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ নৌ রুটে ফেরির মাধ্যমে বাস, ট্রাক, লরি, মিনিবাস, প্রাইভেট কারসহ সব ধরনের যানবাহন সরাসরি দ্বীপে পৌঁছানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। একইসঙ্গে সন্দ্বীপের পর্যটনও উন্নত হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে বর্ষা মৌসুমে উত্তাল সাগরে ফেরি চলাচল সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে রয়েছে কিছুটা শঙ্কা।
প্রধান উপদেষ্টা যা বললেন ॥ ফেরি উদ্বোধন উপলক্ষে সন্দ্বীপ উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে সমাবেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, স্বাধীনতার মাসে সন্দ্বীপে ফেরি চলাচলের এ সুখবর দিতে পেরে আমি আনন্দিত। সন্দ্বীপের এ অগ্রযাত্রা আজ শুরু হলো। আরও সুন্দর হবে।

এভাবে সব অঞ্চলের সুষম উন্নয়নের মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যাবে, এটাই প্রত্যাশা। সন্দ্বীপ দেশের অন্যতম উপকূলীয় দ্বীপ। সন্দ্বীপের মানুষকে এতদিন কাদা মাড়িয়ে ডিঙি নৌকায় আর বোটে করে সমুদ্র পারাপার করতে হয়েছে। ৫০ বছরের মধ্যেও কেন নিরাপদ যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি, কী লজ্জার কথা! সন্দ্বীপের সঙ্গে আজ নিরাপদ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। কেন এতদিন হয়নি. সেটা লজ্জার। এ লজ্জা থেকে বাঁচলাম। কলঙ্ক থেকে আজ মুক্ত হলাম।
তিনি আরও বলেন, সন্দ্বীপে প্রবাসীরা দেশে রেমিটেন্স পাঠিয়ে অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে বিশাল ভূমিকা রাখছে। আমি আপনাদের নিজ নিজ উপজেলার উন্নয়নে কাজ করতে আহ্বান জানাচ্ছি। এ মাইলফলক অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ৫০ বছরের যে কাজ করা হয়নি, তা কম সময়ে সম্পন্ন হয়েছে।
সমাবেশে উপদেষ্টারা যা বললেন ॥ নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, দুটি ঘাটের নাম কাল থেকে জুলাই আন্দোলনে সন্দ্বীপে শহীদ মাহমুদুর রহমান সৈকত ও সাইমুন হোসেন মাহিনের নামে নামকরণের প্রস্তাব করছি। বাংলাদেশের কোনো উন্নয়নই ফলপ্রসূ হবে না যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ উন্নত না হয়। এখানে ফেরি চলাচলের আগে নৌঘাট দখলমুক্ত করতে হয়েছে। সমুদ্র উপকূল হওয়ায় ফেরি চালু করা দুরূহ ছিল।
সড়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, এই ফেরি চালুর মূল কৃতিত্ব আমাদের প্রধান উপদেষ্টার। গত আগস্টে প্রথম উনাকে মহিলাদের কাদা মাটি পেরিয়ে পারাপারের কথা বলি। তিনি বলেন, এটা হতে পারে না। অবশ্যই সমাধান করতে হবে। এটি একটি দুরূহ প্রকল্প কারণ বাংলাদেশে সমুদ্রপথে ফেরি চলাচলের অভিজ্ঞতা নেই। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ। স্বাগত বক্তব্য দেন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা।
কোস্টাল ফেরির কথা জানাল নৌ উপদেষ্টা ॥ সোমবার সকাল ১০টায় উদ্বোধনী ফেরিতে সন্দ্বীপের গুপ্তছড়া ঘাটে নেমে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, সন্দ্বীপ একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা। এর সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। এতদিন এখানে যোগাযোগে বঞ্চিত করা হয়েছে, যা অন্যায়। ফেরি চলাচল শুরু হলো। তবে এটার ধারাবাহিক করতে কিছু সমস্যা আছে। এখানে যে চ্যানেল তা নিয়মিত ড্রেজিং করতে হয়। বছর বছর ড্রেজিং প্রয়োজন।

বর্ষায় এ নৌ রুটে সি-ট্রাক চলাচল করানো হবে। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান বলেছেন, তারা সি-ট্রাক দিবেন। কিন্তু সি-ট্রাকে বেশি গাড়ি নেওয়া সম্ভব হবে না। এখানে কোস্টাল  ফেরি প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশে কোস্টাল ফেরির প্রভিশন নেই। এটা আমাদের আনতে হবে। আপনাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।
সন্দ্বীপের সন্তান বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, নৌপরিবহন উপদেষ্টা ও বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যান সাগরপথে ফেরি সেবা চালুর এই কঠিন কাজকে সফল করেছেন। তারা এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। কঠিন কাজ বলেই এতদিন হয়নি। তবে এটা এখনো চলমান কাজ। সারাবছর যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হলে কোস্টাল ফেরি লাগবে।

উচ্ছ্বসিত সন্দ্বীপবাসী ॥ সন্দ্বীপে প্রথমবারের মতো এত গাড়ি নিয়ে ফেরি পৌঁছাল; এ বিষয়টি অনেকের জন্য আবেগের। উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় চট্টগ্রামমুখী হয়নি লাখ লাখ মানুষ। আবার অনেকে কর্মক্ষেত্রে এলেও বাড়ি যান না দীর্ঘদিন। অনেকে পরিবারের জন্য নিজ ভিটে ছেড়ে বিদেশে চাকরি করলেও বাড়ি না ফিরে ভাড়াবাসায় ফিরেন দেশে এলে।

এসবের নেপথ্যে ছিল কষ্টের যোগাযোগ ব্যবস্থা। এখন ফেরি সেবা চালু হওয়ায় সন্দ্বীপে আসা-যাওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়বে বহুগুণ। প্রথম ফেরি যোগাযোগের এ ইতিহাসের সাক্ষী হতে দূরদূরান্ত থেকে গুপ্তছড়া ঘাটে সমবেত হয়েছিল অনেকে। এক ঘণ্টায় সন্দ্বীপের গুপ্তছড়ায় পৌঁছায় উদ্বোধনী ফেরি। এর আগে সকাল ৯টায় ফেরিটি সীতাকু-ের বাঁশবাড়িয়া থেকে সন্দ্বীপের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
সন্দ্বীপের মুছাপুরের বাসিন্দা মো. লোকমান জানান, হাজার টাকা বোট ভাড়া করে অসুস্থ মানুষ নিয়ে চট্টগ্রাম গেছি এমন ইতিহাস আছে। ঝড়ের সময় টাকা দিয়েও সন্দ্বীপ থেকে সীতাকু- যেতে পারিনি। এখন ফেরি হওয়ায় সেসব কষ্ট থাকবে না। আত্মীয়রা বেড়াতে আসবে। নিজের কষ্ট দূর হবে। গাছুয়ার বাসিন্দা শরীফ উদ্দিন জানান, বহুবছর বাড়ি যাই না। অসুস্থ মা-বাবাকে নিয়ে শহরে থাকি। আজ সন্দ্বীপ গেলাম প্রায় ৮বছর পর। এবারের ঈদ পরিবার নিয়ে বাড়িতেই করব। 
কপোতাক্ষ ফেরি ॥ বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ফেরি কপোতাক্ষ সন্দ্বীপ যাত্রায় ইতিহাস হয়েছে। এ ফেরি একবার যেতে ১ ঘণ্টা ১০ মিনিট সময় নিচ্ছে। জোয়ার এবং ভাটার সময় হিসেব করে দৈনিক ৪ বার আসা-যাওয়া করবে ফেরিটি। কপোতাক্ষ ৩৫টি যানবাহন বহন করতে পারবে। এ ছাড়া ৬শ’ মানুষ এ ফেরি বহন করতে সক্ষম। 
সন্দ্বীপবাসীর দাবি ॥ সকালে ফেরিতে সন্দ্বীপের বাসিন্দারা উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে বিভিন্ন দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ফেরিঘাটের উভয়প্রান্তের সড়ক প্রশস্ত করা, হারামিয়া ২০ শয্যার হাসপাতালকে ৩১ শয্যায় উন্নীত করা, দক্ষিণ সন্দ্বীপের চিকিৎসা কেন্দ্র ১০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা, উড়িরচরের ইউনিয়ন চিকিৎসা কেন্দ্রকে ১০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা এবং দ্বীপের চর্তুদিকে ব্লক বেড়িবাঁধ ও ডাবল লাইন রিং রোড করা। 
কত টাকা ফি ॥ ফেরিতে চলাচলের জন্য ফি নির্ধারণ করা হয়েছে- সাধারণ যাত্রী ১০০ টাকা, মোটরসাইকেল ২০০ টাকা, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা ৫০০ টাকা, ব্যক্তিগত গাড়ি ৯০০ টাকা, বাস ৩ হাজার ৩০০ টাকা, ট্রাক ৩ হাজার ৩৫০ টাকা এবং ১০ চাকার গাড়ি ৭ হাজার ১শ’ টাকা।
এদিকে গত সোমবার ফেরি চালু উপলক্ষে ঢাকা-সন্দ্বীপ রুটে বিআরটিসির বাস চলাচলও উদ্বোধন করেন উপদেষ্টারা। সোমবার থেকে চট্টগ্রামের এয়ারপোর্ট-সি বিচ-নিমতলা-নয়াবাজার-কুমিরা-বাঁশবাড়িয়া ফেরিঘাট-সন্দ্বীপ এনাম নাহার মোড় রুটে চালু হয়েছে এসি বাস সার্ভিস।

×