
কক্সবাজার : সমুদ্রের বালিয়াড়িতে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন
কক্সবাজারে ইসিএ আইন উপেক্ষা করা হচ্ছে বারবার। টাকা ও ক্ষমতার জোরে সমুদ্রের বালিয়াড়িতে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল ভবন। প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে রাতেও চালানো হচ্ছে দালান নির্মাণ কাজ। পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে বালিয়াড়িতে এসব বিল্ডিং নির্মাণ কাজ চলছে।
সূত্র জানায়, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তক্রমে সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপে ইসিএ রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে পর্যটন জোন খ্যাত কলাতলীতে ইসিএ লঙ্ঘন হলেও কোনো ধরনের পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বহুতল ভবন নির্মাণ বন্ধে প্রশাসনের কঠোরতার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়াও ইসিএ-তে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধকল্পে উচ্চ আদালতের দেওয়া নির্দেশনাও তোয়াক্কা করছেন না লোভী ব্যবসায়ীরা। স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান (এসটিপি) বিহীন ভবন নির্মাণ হলেও তাদের পরিবেশ বিধ্বংসী কাজে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে মোটা দাগের ঘুষ পেয়ে নীরব ভূমিকা পলন করছেন প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তা। কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক জমির উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, বালিয়াড়িতে দালান নির্মাণকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে লাবণী পয়েন্ট থেকে কলাতলী ও আশপাশের বেলাভূমি তীরে থেমে থেমে চলা স্থাপনার বিষয়ে ‘উই ক্যান কক্সবাজার’ নামে একটি পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে গত নভেম্বরে অভিযোগ দেয়। এতে ইসিএ আইন ও এসটিপি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের আন্তরিক কর্মতৎপরতা কামনা করে আবেদন দেওয়ার পর কিছুদিন থেমেছিল নির্মাণ কাজ। কিন্তু রোজার শেষের দিকে অর্থাৎ ২৬ মার্চ হতে ঈদের টানা বন্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে দ্রুত নির্মাণ সম্পন্ন করতে সেসব স্থাপনায় আবারও তোড়জোড় করে কাজ চালানো হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন উই ক্যান নেতৃবৃন্দ। রাতেও এসব স্থাপনায় চলছে নিরবচ্ছিন্ন কাজ। এ ব্যাপারে পরিবেশ উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন পরিবেশবাদী নেতৃবৃন্দ।
জানা যায়, সৈকত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এ গেজেট অনুযায়ী সৈকতের বেলাভূমির নির্দিষ্ট এলাকায় স্থাপনা নিষিদ্ধ। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দায়ের করা রিটের সূত্র ধরে ইসিএ’তে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের নির্দেশনা দিয়েছেন হাইকোর্ট। এরপরও অজ্ঞাত কারণে সেখানে অহরহ উঠছে দালান। অপরিকল্পিত স্থাপনা ও ভয়াবহ দূষণের ঝুঁকিতে পড়তে যাওয়া পর্যটন নগরীকে রক্ষায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে গত নভেম্বরে আবেদন দেয় ‘উই ক্যান কক্সবাজার’ নামে একটি পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন। তারা ইসিএ আইন ও এসটিপি বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসনের আন্তরিক কর্মতৎপরতা কামনা করেন। এটি গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে ভবন নির্মাণকারীরা কিছুদিন হাতগুটিয়ে রাখে। কিন্তু গত সপ্তাহ হতে একাধিক স্থাপনায় ফের পুরোদমে নির্মাণ কাজ চালানো হচ্ছে।
উই ক্যান কক্সবাজারের প্রধান নির্বাহী ওমর ফারুক জয় বলেন, দেশের দক্ষিণে নীল জলরাশির জানালায় নির্মল প্রকৃতি উপভোগে কক্সবাজারে আসেন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা। অসচেতনতা ও আইন অমান্যের কারণে দূষিত হচ্ছে এখানকার পরিবেশ। যা পর্যটকদের মাঝে কক্সবাজার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক করিম উল্লাহ কলিম বলেন, ইসিএতে স্থাপনা নির্মাণে নিষেধাজ্ঞায় গেজেট ও আদালতের নির্দেশনা থাকলেও কলাতলীর ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের পূর্বে লাগোয়া এবং মধ্যকলাতলীতে বহু স্থাপনা গড়ে উঠছে। গত কয়েক মাস নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকলেও ঈদুল ফিতরের টানা ছুটিকে টার্গেট করে আবারও ছাদ ঢালাইয়ের তোড়জোড় করছে ডিভাইন এলাকার নির্মিতব্য স্থাপণায়। গত এক-দু’দশক আগে গড়া হোটেলে এসটিপি নেই, কিন্তু প্রশাসনিক তদারকিহীনতায় চলমান সময়ে গড়ে ওঠা অবৈধ এসব স্থাপনাতেও হচ্ছে না এসটিপি। ফলে শহরের পরিবেশ সামনের দিনে আরও দূষিত হবে। ভয়াবহ দূষণে পড়ছে পর্যটন জোনও।
পরিবেশবাদী নেতা এইচএম নজরুল বলেন, কক্সবাজারে আসা পর্যটকদের আবাসন সেবায় এখানে গড়ে উঠেছে পাঁচ শতাধিক হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউস-কটেজ। রয়েছে তিনশোর বেশি রেস্তোরাঁ-কুলিং কর্ণারও। এরই মাঝে অনুমতিহীন বিনা বাঁধায় ইসিএ-তে ভবন উঠছে কিসের ইঙ্গিতে। পরিবেশ আইন না মানায় ধীরে ধীরে বাস অনুপযোগী হয়ে উঠছে পুরো শহর। ছাড়পত্রবিহীন ভবন নির্মাণ বন্ধ করা জরুরি।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, পরিকল্পিত কক্সবাজার গড়তে মাস্টারপ্ল্যানকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আগে কি হয়েছে জানি না। তবে, এখন পরিচ্ছন্ন কক্সবাজার করতে যা দরকার তাই করা হবে। ঈদটা চলে যাক, যারা নির্দেশনা মানছে না- তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, সরকারের নির্দেশে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ হিসেবে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষকে (বেজা) ইকোট্যুরিজম পার্ক করতে দেওয়া সোনাদিয়া দ্বীপের প্রায় সাড়ে ৯ হাজার একর বনভূমি আট বছর পর আবার বন বিভাগকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।