
বিএফইউজে মহাসচিব কাদের গনি চৌধুরী বলেছেন, সাংবাদিকদের সত্য উদ্ঘাটন, অনুসন্ধান ও প্রকাশে নির্ভীক হতে হবে। অর্ধসত্য নয়, সত্য ও অসত্যের মিশ্রণও নয়, তাদের প্রকাশ করতে হবে অখণ্ড ও পূর্ণ সত্য।
তিনি বলেন, "সত্য প্রকাশ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের চাকরির ঝুঁকি, জীবনের ঝুঁকিসহ নানা ঝুঁকি নিতে হয়। সাংবাদিকরা এই ঝুঁকি না নিলে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে কীভাবে? অসহায় আত্মসমর্পণ সাংবাদিকদের মানায় না। বিগত সরকারের সময় আমাদের সাংবাদিকদের বিরাট অংশকে আমরা অসহায় আত্মসমর্পণ করতে দেখেছি সেল্ফ সেন্সরশিপের মাধ্যমে।"
মনে রাখতে হবে, সত্য প্রকাশে বাধা ও বিপদের সম্মুখীন হলেও সমাজের সাধারণ মানুষ সাংবাদিকদের পাশে এসে দাঁড়ায়।
রবিবার (২৩ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়ন আয়োজিত আলোচনা সভা ও ইফতার মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন।
কুষ্টিয়া সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুর রাজ্জাক বাচ্চুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহী, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমি, সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যক্ষ সোহরাব হোসেন, কুষ্টিয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি আল মামুন সাগর, জামায়াত সেক্রেটারি সুজা উদ্দিন জোয়ার্দার, ইসলামি আন্দোলনের আহমদ আলী, বিএফইউজের দফতর সম্পাদক আবু বকর, পিপি এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও এড. সাতিল মাহমুদ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন শামীউল হাসান অপু।
কাদের গনি চৌধুরী বলেন, "জীবনে কোনো ক্ষেত্রে মিথ্যার সঙ্গে আপস করা চলবে না, তাহলেই সাংবাদিকতা হবে না। সত্যের তরে দৈত্যের সাথে লড়াই করাই সাংবাদিকতা। সত্য প্রকাশই হতে হবে গণমাধ্যমের একমাত্র অঙ্গীকার।"
তিনি আরও বলেন, "সাংবাদিকতা হচ্ছে সবচেয়ে জীবন্ত ও আধুনিক পেশা। এটি একটি বুদ্ধিবৃত্তিক পেশা, সাংবাদিকতা কখনও মূর্খজনের পেশা নয়। পেশা হিসেবেই সাংবাদিকতা বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের পেশা। যে মানুষ অতীতকে ধারণ করে বর্তমানের সঙ্গে তা মিলিয়ে ভবিষ্যতের নির্দেশনা দিতে না পারেন, ভাষায়-ব্যাখ্যায়-উপস্থাপনায় যিনি মেধার ছোঁয়া না বুলাতে পারেন, তিনি আর যা-ই হোন, সাংবাদিক হতে পারেন না।"
কাদের গনি চৌধুরী আরও বলেন, "কিছু মৌলিক কাঠামোই সাংবাদিকতাকে আধুনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার শক্ত ভিত্তি দিয়েছে। সাংবাদিকতাকে দাঁড়াতে হয় এই মৌলিক ভিত্তির উপর। একটি সমাজে মত প্রকাশের স্বাধীনতাটি যদি নিশ্চিত না থাকে, সমাজটি যদি চিন্তা ও বিবেকের জন্য খোলা প্রান্তর অবারিত করতে না পারে, সেই সমাজে স্বাধীন বা মুক্ত সাংবাদিকতা বিকশিত হতে পারে না। সাহসী ও বুদ্ধিবৃত্তিক সাংবাদিকতার ভিতও দৃঢ় হয় না।"
তিনি বলেন, "আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলি কিন্তু নৈতিকতা ও দায়িত্বশীলতার কথা বলি না। আজকাল প্রায়শই সংবাদ মাধ্যম বা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্বশীলতা ও নৈতিকতার বিষয়টি উচ্চারিত হয় জোরেসোরে।"
সংবাদ মাধ্যমের প্রথাগত দায়িত্বটির মধ্যে রয়েছে, মানুষকে তথ্য জানানো, সেই তথ্য জানানোর মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষিত ও সচেতন করা, তথ্য ও আলোচনার মাধ্যমে বিনোদন দেওয়া এবং সময়ের প্রয়োজনে মানুষকে উদ্দীপ্ত করা।
তিনি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার স্মৃতিচারণ করে বলেন, "১৯৭০ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন যখন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছিল, সে সময়কার পূর্বপাকিস্তানের এক দল সম্পাদক পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়ে এক সাংবাদিক বন্ধু মি. সুলেরীকে বলেছিলেন, 'তোমরা পূর্বপাকিস্তানের সংবাদপত্রে এখন সাংবাদিকতার চাইতে রাজনীতিটাই বেশি করছ।' মানিক মিয়া হাসি মুখে জবাব দিয়েছিলেন, 'সুলেরী, পূর্ববঙ্গে এখনকার যা পরিস্থিতি, যে জনআকাঙ্ক্ষা আমরা তার সাথে মিলিয়েই সাংবাদিকতা করছি।'"
তিনি আরও বলেন, "সাংবাদিকতা যেহেতু জনমানুষের আশ্রয়েই বেঁচে থাকে, কাজেই পেশাদারিত্ব বজায় রেখেই নতুন দায়িত্বও মাথায় নিতে হয়। দায়িত্বশীলতা প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতার সাথে এমনভাবে ঘনিষ্ঠ যে, সেজন্য পৃথক কোনো সংজ্ঞার প্রয়োজন হয় না। কারণ সাংবাদিকতা পেশাটিই দায়িত্বশীল পেশা। প্রকৃত পেশাদার সাংবাদিকতা কখনও 'অ-দায়িত্বশীল' হতে পারে না। যারা দায়িত্বহীনভাবে সাংবাদিকতা পেশাকে ব্যবহার করেন, তারা আর যাই হোক 'সাংবাদিক' নন।"
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, গণমাধ্যম বা সাংবাদিক কার প্রতি দায়বদ্ধ থাকবে, কার কাছে জবাবদিহি করবে? তিনি বলেন, "গণমাধ্যমের দায়বদ্ধতা সমাজের প্রতি। সমাজের পাঠক বা দর্শকই তো তার ভোক্তা। তারা ভালো লাগলে গ্রহণ করবেন, না হলে প্রত্যাখ্যান করবেন। সেই গণমাধ্যমই টিকে থাকবে, যেটি মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারবে।"
তিনি উল্লেখ করেন, "এখন বিশ্বজুড়ে সংবাদ মাধ্যমের বড় সংকট 'ফেক নিউজ'। এই সংকট প্রথম শুরু হয় আমেরিকা থেকে, পরে ভারতীয় উপমহাদেশে 'পেইড নিউজ' এর মাধ্যমে। বাংলাদেশে এটি ভয়াবহভাবে দেখা দিয়েছে বিগত সরকারের সময়। পেশাদারী সাংবাদিকতার জন্য এটি বড় সংকট।"
"প্রশ্ন হলো— সাংবাদিকতা কি টিকে থাকতে পারবে, নাকি 'ফেক নিউজ' এর স্রোতে ডুবে যাবে?"— এমন প্রশ্নও করেন তিনি। "পেশাদার সাংবাদিকতা একমাত্র সমাধান, সাংবাদিকতার মৌলিক শর্তগুলোই সাংবাদিকতাকে রক্ষা করতে পারে।"
এম.কে.