ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১

বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে, কুড়িতে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে চন্দ্রদ্বীপের নারীরা

নিজস্ব সংবাদদাতা, বাউফল, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ০৫:১৩, ২২ মার্চ ২০২৫

বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে, কুড়িতে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে চন্দ্রদ্বীপের নারীরা

ছবি: কিশোরী বয়সে সন্তানের মা হয়েছেন এসব নারীরা

বাউফলের নদী বেষ্টিত চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের করিম জান বিবি। বয়স ত্রিশোর্ধ নয়। অথচ তাকে দেখলে মনে হয় ৬০ বছরের এক বুড়ি। ৬ কন্যা সন্তানের জননী তিনি। চন্দ্রদ্বীপের ব্যারেড গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দিক মোল্লার সাথে যখন বিয়ে হয়, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। এরপর বছর না ঘুরতেই করিমজানের কোলে আসে প্রথম সন্তান হাজেরা। 

এভাবে একেরপর এক তার গর্ভে জন্ম হয়, ফেরদৌসি, হেলেনা, রাহিমা, জান্নাত ও রহিমা নামের ৬ কন্যা সন্তানের। হাজেরা, ফেরদৌসি ও হেলেনাকে  তাদের মা করিম জানেরমতই ভাগ্য বরন করতে হয়েছে। তারাও বাল্য বিয়ের শিকার হন। এদের মধ্যে আবার হাজেরা এখন দুই সন্তানের জননী, ফেরদৌসীর এক সন্তানের আর হেলেনা সন্তান সম্ভবা। যে বয়সে ওদের সহপাঠীদের সাথে বিদ্যালয়ের আঙিনায় খেলা করার কথা সেই বয়সে তাদেরকে সামলাতে হচ্ছে ঘরকন্যার কাজ। 

এ ভাবেই এই চন্দ্রদ্বীপের কন্যাদের শিশুদের বয়সেই বসতে হয় বিয়ের পিরিতে। এরপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই গর্ভবতী হন তারা। দারিদ্রতা আর কুসংস্কারের কারণে গর্ভাবস্থায় এইসব শিশু বধূদের ভাগ্যে জোটেনা কোন স্বাস্থ্য পরিচর্যা। প্রসবকালীন সময়ে পাশে থাকেনা কোন প্রশিক্ষিত ধাত্রী। ডাক্তার নার্স তাদের কাছে স্বপ্নেরমত। 

এই চন্দ্রদ্বীপে এখনও মরিচ পুড়ে তা প্রসূতি মায়েদের নাকের কাছে ধরে হাঁচি দিয়ে বাচ্চা প্রসব করানো হয়। পোড়া মরিচের ঝাচে হাঁচি দিলে দ্রুত সন্তান প্রসব হয় এমন ধারণা এখনও বিরাজ করছে তাদের মধ্যে। তাই এ দ্বীপ ইউনিয়নের কিশোরীদের স্বপ্ন তেঁতুলিয়া নদীর লোনা পানিতে ভেসে যায় দূর বহূ দূরে।

চন্দ্রদ্বীপের চর ফেডারেশনের আলম ফকিরের স্ত্রী ফেরোজা বেগম (২৫) জানায়, তার বিয়ে হয় ১০বছর আগে। তিনি এখন ৩ মেয়ে ১ ছেলের জননী। তার স্বামী আরও সন্তান নিতে চায়। এ চরের গৃহবধূ শাহিনুরের ৬ সন্তান, হেলেনার ৫ সন্তান, হাসিনার ৪ সন্তান। এদের প্রত্যেকের স্বামী আরও সন্তান নিতে চায়। তাদের ধারনা হচ্ছে বেশি সন্তান হলে ভূমি দস্যু লাঠিয়ালদের হাত থেকে ফসল রক্ষা করতে পারবে। পাশাপাশি আয় রোজগারও বেশি হবে। 

এ চরের শতকরা ৬০জন কৃষক ৩০জন জেলে ও ১০ জন লোক নিয়মিত কোন পেশায় নেই। পাঁচ সন্তানের জননী চরমিয়াজানের রেহেনা বেগম (৩৫) বলেন, আল্লাহর দেয়া সৃষ্টিতে বাধা দিলে তিনি গোস্বা হন। ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারে ব্যাপক ভাবে জড়িয়ে পরেছেন তারা। জন্ম নিয়ন্ত্রণে পদ্ধতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণা নেই। তাই তারা প্রকৃতির নিয়মেই সন্তান জন্ম দেন। এ ছাড়াও অধিক সন্তান অধিক উপার্জন। এই বিশ্বাসের কারণে  এ দ্বীপের বাসিন্দারা সহজে জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ব্যবহার করেননা। তাই বছরের পর বছর বাড়ছে মানুষ। বাড়ছে নতুন বাড়িঘর। কমছে আবাদি জমি। 

চরের মানুষ নিয়ে কাজ করেন এমন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের  কর্মী সাইফুল ইসলাম জানান, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ থাকলেও বাউফলে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে জনবল সংকট, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন  চরাঞ্চল গুলো দুর্গম এলাকা হওয়ায় পরিবার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন কার্যক্রম আলোর মুখ দেখছে না। সেখানে পৌছায়না জন্ম নিয়ন্ত্রণের শ্লোগান ‘‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভাল হয়”। চন্দ্রদ্বীপ ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। কৃষি কাজ ও নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বহ করেন। তারা কেউই শিক্ষিত নন। ধর্মীয় গোড়ামি ও কুসংস্কারের কারণে এখানে অধিকাংশ মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্বতি অবলম্বন করেন না। তাই একটি পরিবারে অধিক সন্তান থাকায়, বাল্য বিয়ে বেশি হচ্ছে।

রিফাত

×