
তিস্তা সেচ প্রকল্পের প্রধান খাল থেকে টারশিয়ারি খালের মাধ্যমে বোরো ধানের জমিতে সেচের পানি পাচ্ছেন কৃষক
কাকডাকা ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে তাদের। সেচের পানিতে নেই কোনো ঘাটতি। সার, বীজসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ হাতের নাগালে থাকায় দুশ্চিন্তাও নেই। সবার চোখেমুখে একটিই স্বপ্ন মাঠভরা বোরো ধানের সবুজ খেত। ধানের চারা রোপণের পর পরিচর্যায় সময় দিতে হবে।
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ শ্যামলিমায় ভরপুর নীলফামারীসহ উত্তরাঞ্চলের ৫ জেলার প্রতিটি উপজেলার বোরো খেতের মাঠ। চলতি বছরে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বেশ। ধান উৎপাদনও হবে বাম্পার। আশাবাদী মাঠের নায়ক কৃষককুলের। এবার বোরো আবাদ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে কৃষকরা বলছেন বাজারে ধানের দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে।
অপরদিকে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের মাধ্যমে চলতি খরা মৌসুমে বোরো চাষে ব্যাপক সাফল্য এনেছে। প্রতিটি সেচখালে ভরপুর পানি। সেই পানিতে চলছে বোরো খেতে সেচ কার্যক্রম। নদীতে এখন পানিপ্রবাহ ৩ হাজার কিউসেক ছেড়ে প্রায় ৫ হাজার কিউসেক প্রবাহ হচ্ছে। ফলে তিস্তার সেচে বোরো আবাদে পানির কোনো ঘাটতি নেই।
বুধবার রংপুর কৃষি অঞ্চলের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. আফজাল হোসেন বলেন, চলতি মৌসুমে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় ৫ লাখ ৮ হাজার ৯৭৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো চাষ হয়েছে ৫ লাখ ৯ হাজার ৫৬ হেক্টর জমিতে। এতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭৮ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো চাষ হয়েছে।
এর মধ্যে নীলফামারীতে ৮১ হাজার ৮৫৯ হেক্টর, রংপুরে ১ লাখ ৩২ হাজার ৮০০ হেক্টর, গাইবান্ধায় ১ লাখ ২৯ হাজার ২০ হেক্টর, কুড়িগ্রামে ১ লাখ ১৭ হাজার ৩৬২ হেক্টর ও লালমনিরহাটে ৪৮ হাজার ১৫ হেক্টরে। গত বছর (২০২৪) ৫ লাখ ৭ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। যা গত বছরের চেয়ে এবার ১ হাজার ২২১ হেক্টর জমিতে বেশি বোরো আবাদ হচ্ছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে এবার বোরো ধানের বাম্পার ফলন হবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সেচ প্রকল্পের খাল নীলফামারীর ডালিয়াস্থ তিস্তা ব্যারাজ থেকে শুরু হয়ে রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় বিস্তৃত। মোট সেচ খালের দৈর্ঘ্য ৭৬৬ কিলোমিটার। প্রধান খাল, সেকেন্ডারি খাল, মেজর খাল ও সবশেষে টারশিয়ারি খালের মাধ্যমে বোরো জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে।
বাপাউবোর উত্তরাঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, এই প্রকল্পটির বর্তমানে পূর্ণাঙ্গ সক্ষমতার আংশিক ব্যবহার করে উত্তরাঞ্চলের রংপুর, দিনাজপুর ও নীলফামারী জেলার ১২টি উপজেলায় সেচ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি। নতুন উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হলে এর সক্ষমতা বহুলাংশে বাড়বে।
তিনি জানান, ‘তিস্তা সেচ প্রকল্প কমান্ড এলাকার পুনর্বাসন, সংস্কার ও পরিবর্ধন প্রকল্প’টির শেষ হওয়ার সময় ছিল ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। এটি এখন দুই বছর সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর মাসে কাজ শেষ হলে ২০২৭ সালের জানুয়ারি থেকে এক লাখ ৪ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে।’
বোরো ফসল নিয়ে নিজের স্বপ্নের কথা জানান সদর উপজেলার রামনগর এলাকার চাষি কামরুল ইসলাম (৪০)। তিনি তিস্তার সেচে ১০ একর জমিতে বোরো আবাদ করছেন। তার ফসলি জমিতে ইতোমধ্যেই বোরোর চারা রোপণ কাজ শেষ। এখন পরিচর্যা চলছে। বোরো শ্রমিক আলামিন (৩০) জানান, বোরোতে শুধু কৃষকই নয়, শ্রমিকরাও লাভবান হয়। এ সময় কাজের কোনো অভাব থাকে না। প্রতিদিন কৃষকের খেতে শ্রম দিলে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা মজুরি মেলে।
তিস্তা সেচ প্রকল্পের উপসম্প্রসারণ কর্মকর্তা অমলেশ চন্দ্র রায় জানান, দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের কমান্ড এলাকায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদান করা হচ্ছে। এরমধ্যে নীলফামারী জেলায় ৩৩ হাজার হেক্টর, রংপুর জেলায় ১০ হাজার হেক্টর, দিনাজপুর জেলায় ৭ হাজার হেক্টর। যা একর হিসাবে ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৫০।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, তিস্তা কমান্ড এলাকার সেচ খালে কৃষকরা আউটলেট থেকে পানি নেওয়ার জন্য মাঠ নালা তৈরি, তিন মাস সেচ গ্রহণ মজুরি ও বিবিধ বাবদ মোট ১ হাজার ৫০০ টাকা করে একরে প্রদান করে থাকে। যা প্রতি মাসের সরকারি হিসাবে ৪০০ টাকা একর ও আদায় খরচ ২০% অতিরিক্ত হিসেবে ৮০ টাকা সর্বমোট ৪৮০ টাকা প্রতি একর সরকারি কোষাগারে জমা পড়ে। ওই পরিমাণ জমিতে সেচের জন্য সরকারি কোষাগারে পাঁচ কোটি ৯৩ লাখ ৪ হাজার টাকা রাজস্ব আয় করেছেন এবার।
জলঢাকা উপজেলার কাঠালি গ্রামের কৃষক আব্দুল হামিদ জানান, তিস্তা সেচ প্রকল্পটি চালুর আগে তাদের এলাকায় জমিতে তেমন ফসল উৎপাদন হতো না। এখন তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানি ব্যবহার করে বা¤পার ফসল ফলাচ্ছেন। ডিমলার চাঁপানী এলাকার কৃষকরা বলেন, ‘তিস্তার পানি দিয়ে ফসল উৎপাদন করতে খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ কম লাগে, আর ফসল উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ বেশি হয়।’
ডালিয়া গ্রামের কৃষক আবু বক্কর জানান, গত ৩০/৩৫ বছর ধরে তিনি তিস্তা সেচ প্রকল্পের পানি দিয়ে ফসল ফলাচ্ছেন। তিস্তার পানিতে ফসল ফলাতে উৎপাদন খরচ কম হয়।