
যমুনা রেল সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে সাজানো হয়েছে বিশেষ ট্রেন
প্রমত্ত যমুনার বুকে নির্মিত সেতু দিয়ে ১২০ কিলোমিটার গতিতে নিয়মিত ট্রেন চলাচলের মধ্য দিয়ে স্বপ্নের যমুনা রেল সেতুর উদ্বোধন করা হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে টাঙ্গাইলের ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন থেকে স্পেশাল ট্রেন পশ্চিমে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদ স্টেশনে পারাপারের মধ্য দিয়ে সেতুটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
সেতুটি উদ্বোধনের মাধ্যমে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হলো। ৪.৮ কিলোমিটার মূল সেতু পার হতে উদ্বোধনী ট্রেনটি ১২০ কিলোমিটার গতিতে সময় নেয় তিন মিনিট ২১ সেকেন্ড।
এর আগে এদিন সকাল সাড়ে ১০টায় ইব্রাহিমাবাদ রেল স্টেশনে চত্বরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। পৌনে ১২টার দিকে সেতুর পূর্ব পাশে ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন এলাকায় ফলক উন্মোচন, ফিতা কেটে ও বেলুন উড়িয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব এম ফাহিমুল ইসলাম সেতুটির উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক এম আফজাল হোসেনের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত সাইদা শিনিচি এবং জাপানের বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থা জাইকার দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মহাপরিচালক ইতো তেরুয়ুকি।
স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসুদুর রহমান। এছাড়াও বক্তব্য রাখেন- যমুনা রেল সেতুর প্রকল্প পরিচালক আল ফাত্তাহ মাসুদুর রহমান, জাপানি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সানজিহু কাফিকু ও মার্ক হ্যাপি। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, জাইকার কর্মকর্তা এবং সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এর ফলে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হলো। বিশেষ করে উত্তর-দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকার রেল যোগাযোগ আরও সহজ হলো। এতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় অগ্রযাত্রা আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। তবে ডাবল লেনের হলেও বর্তমানে সিঙ্গেল লেন চালু হওয়ায় সেতুটির পুরোপুরি সুফল সহসাই মিলছে না যাত্রীদের।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে ট্রেনের অতিথি ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পূর্ব ইব্রাহিমাবাদ স্টেশন থেকে সেতু পার হয়ে সিরাজগঞ্জের পশ্চিম প্রান্তে সয়দাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে যান। সেখানে সংবাদ সম্মেলন শেষে পুনরায় সেতুর পূর্ব প্রান্তে ফিরে আসেন।
সেতুটি ৫০টি পিলার এবং ৪৯টি স্প্যানের ওপর নির্মিত। নতুন রেলওয়ে সেতুটি যমুনা বহুমুখী সেতুর ৩০০ মিটার উজানে অবস্থিত। দেশের দীর্ঘতম ও আধুনিক এই সেতুর ওপর দিয়ে দিনে ৮৮টি ট্রেন দ্রুতগতিতে চলাচল করতে পারবে। বিগত ১৯৯৮ সালে যমুনা বহুমুখী সেতু উদ্বোধনের পর থেকে প্রায় ৩৮টি ট্রেন প্রতিদিন তুলনামূলকভাবে ধীর গতিতে যাতায়াত করে।
এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী থেকে সিল্ক সিটি এক্সপ্রেস ট্রেন প্রথমবারের মতো যাত্রী নিয়ে যমুনা রেল সেতু পার হয়ে ঢাকায় পৌঁছায়। পরীক্ষামূলকভাবে ট্রেন চালানোর সময় একটি ট্রেন ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে সেতুটি অতিক্রম করেছিল। এতে সেতুটি পাড়ি দিতে সময় লেগেছিল প্রায় সাড়ে ৩ মিনিট।
যমুনা রেল সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ প্রকল্পের ব্যয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২৭ দশমিক ৬০ শতাংশ অর্থায়ন এসেছে দেশীয় উৎস থেকে এবং ৭২ দশমিক ৪০ শতাংশ ঋণ দিয়েছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)। জাপানি পাঁচটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে।
জাপান, ভিয়েতনাম, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশের ৭ হাজারেরও বেশি কর্মীর টানা চার বছরের পরিশ্রমে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হয়। সেতুটিতে ৫০টি পিলার ও প্রতি দুই পিলারের মাঝে একটি করে মোট ৪৯টি স্প্যান রয়েছে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার হলেও দুদিকে ৭ দশমিক ৬৬৭ কিলোমিটার রেলওয়ে অ্যাপ্রোচ এমব্যাংকমেন্ট এবং লুপ, সাইডিংসহ মোট ৩০ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে।
যমুনা রেল সেতু প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী তানভীরুল ইসলাম জানান, সমান্তরাল ডুয়েল গেজ ডাবল ট্র্যাকের এ সেতুর প্রতিটি স্প্যানের ওপর জাপানিদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির রেললাইন বসানো হয়েছে। ফলে, সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলাচল করতে পারবে। তিনি জানান, নির্মিত সেতুটি ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
ঢাকার সঙ্গে রাজশাহী, রংপুর ও খুলনা অঞ্চলের রেল যোগাযোগে বর্তমান যে বিড়ম্বনা রয়েছে, সেটা আর থাকবে না। সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন অন্তত ৮৮টি যাত্রীবাহী ও মালবাহী ট্রেন চলাচল করবে। পরিবহন খরচও কমে যাবে। সেই সঙ্গে মহাসড়কের ওপর চাপও অনেকটা কমে আসবে। উত্তরবঙ্গ থেকে বিভিন্ন পণ্য সহজেই ঢাকাসহ সারাদেশ রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
প্রসঙ্গত, বিগত ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন প্রমত্তা যমুনা নদীর ওপর যমুনা বহুমুখী সেতু চালু হওয়ার পরই ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ শুরু হয়। তবে ২০০৮ সালে সেতুতে ফাটল দেখা দেওয়ায় ট্রেনের গতি কমিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করতে থাকে। গতি কমের কারণে সময়ের অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে শিডিউল বিপর্যয়।
এসব সমস্যা সমাধানে সরকার যমুনা নদীর ওপর আলাদা রেলওয়ে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বিগত ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের নকশা প্রণয়নসহ সেতুর নির্মাণ ব্যয় প্রথমে ৯ হাজার ৭৩৪ কোটি ৭ লাখ টাকা ধরা হয়েছিল। পরে প্রকল্পের ব্যয় বাড়িয়ে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা করা হয়।
বিগত ২০২০ সালের ২৯ নভেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে যমুনা নদীর ওপর নির্মিত যমুনা বহুমুখী সেতুর ৩০০ মিটার উজানে দেশের দীর্ঘতম ডুয়েলগেজ ডাবল ট্র্যাকের রেলওয়ে সেতুর নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। জাপানের আইএইচআই, এসএমসিসি, ওবায়শি করপোরেশন, জেএফই এবং টিওএ করপোরেশন এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠান তিনটি প্যাকেজে সেতুর নির্মাণকাজ করে।
বিগত ২০২১ সালের মার্চে পিলার নির্মাণের জন্য পাইলিং কাজ শুরু হয়। ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেল সেতু দেশের দীর্ঘতম প্রথম ডাবল ট্রাকের ডুয়েল গেজের সেতু। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বে আসার পর সেতুটির নাম ‘বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু’ পরিবর্তন করে ‘যমুনা রেল সেতু’ করা হয়।