
শেরপুর অঞ্চলে কার্পাস তুলা চাষ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে
কৃষি ও খাদ্যসমৃদ্ধ অঞ্চল হিসেবে শেরপুর পরিচিত অনেক আগে থেকেই। সেই পরিচিতির পালকে নতুন যুক্ত হয়েছে কার্পাস তুলার নাম। চরাঞ্চলের অপেক্ষাকৃত অনুর্বর ও নিষ্ফলা জমিতে এ তুলার চাষ হয়। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে এর বাম্পার ফলন হয়েছে। স্বল্প খরচে প্রায় চারগুণ লাভ হয়েছে চাষিদের।
নিষ্ফলা জমিতে তুলার চাষ এ অঞ্চলের অনেককে উৎসাহী করে তুলেছে। আর এই আগ্রহের কারণেই এ অঞ্চলে তুলা চাষে বাড়তি অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনের সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে।
কার্পাস তুলা জলবায়ু সহনশীল আঁশজাতীয় একটি ফসল। দীর্ঘদিন ধরেই শেরপুরের চরাঞ্চলে বিশেষত ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এটি চাষ হয়ে আসছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ছোঁয়ায় দিন দিন বাড়ছে তুলার আবাদ। একদিকে স্বল্প খরচে লাভ বেশি, অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত অনুর্বর ও নিষ্ফলা জমিতে এ তুলার চাষ করা যায়। চাষের জন্য উৎকৃষ্ট মাটি হলো দোআঁশ ও বেলে দোআঁশ। তবে, পর্যাপ্ত জৈবপদার্থ সমৃদ্ধ যেকোনো মাটিতেই তুলার চাষ করা যায়।
আগাম শীত এলাকায় শ্রাবণ থেকে ভাদ্রের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে এবং খরা মৌসুমে তুলা আবাদের জন্য জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে বীজ বপন করতে হয়। তুলা থেকে বস্ত্র, সুতা ও টিস্যু পেপারসহ বিবিধ দ্রব্য তৈরি হয়। আর তুলার বীজ থেকে ভোজ্যতেল, সাবান ও গ্লিসারিনের কাঁচামাল তৈরি হয়। কার্পাসের কদর থাকায় এটিকে স্থানীয় কৃষকরা ডাকছেন ‘সাদা সোনা’ নামে।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের শেরপুর ইউনিট অফিস সূত্র জানায়, জেলায় চলতি মৌসুমে তিনটি ইউনিটের তত্ত্বাবধানে ২৭৬ হেক্টর জমিতে কার্পাস তুলার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে শেরপুর সদর উপজেলায় ১০৮ হেক্টর, শ্রীবরদী উপজেলায় ৮৪ হেক্টর ও নকলা উপজেলায় ৮৪ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৯ মেট্রিক টন।
জানা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর দ্বিগুণের চেয়েও বেশি জমিতে তুলা চাষ করা হয়েছে। গতবছর নকলা ইউনিটে ৪০ হেক্টর জমিতে তুলার আবাদ হয়েছিল। এ বছর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৪ হেক্টরে। মোট ১৪৬ কৃষক তুলা চাষ করেছেন। এছাড়া, সরকারি সহযোগিতায় বিভিন্ন প্রদর্শনী ও কৃষকের নিজ অর্থায়নেও চাষ করা হয়েছে। ভালো ফলন ও ন্যায্য দাম পাওয়ায় আগামীতে চাষির সংখ্যা আরও বাড়বে বলে আশা করছেন তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাসহ স্থানীয় কৃষকরা।
২০১৫ সালে জেলায় সরকারি সহযোগিতায় পরীক্ষামূলকভাবে উন্নত জাতের তুলা চাষ শুরু হয়। ওই বছর কৃষকরা সিবি-১২ এবং হাইব্রিড প্রজাতির রূপালি-১ জাতের তুলার চাষ করছিলেন। ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের আগ্রহ বাড়তে থাকে। এ বছর কৃষকরা হোয়াইট গোল্ড-১, হোয়াইট গোল্ড-২, পালী-১, সিডিবি হাইব্রিড-১, সিবি-১৪ জাতের তুলা বেশি চাষ করেছেন।
চন্দ্রকোনা ও চরঅষ্টধর ইউনিয়নের তুলা চাষিদের দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসারে সচ্ছলতা ফিরে আসায় অন্যান্য এলাকার কৃষকরাও তুলাচাষে আগ্রহী হচ্ছেন। তিনি আরও জানান, রূপালি-১, হোয়াইট গোল্ড-১ ও হোয়াইট গোল্ড-২ জাতের তুলা প্রতিবিঘাতে বীজসহ উৎপাদন হয় গড়ে ১৫ মণ থেকে ১৮ মণ করে। গত বছর প্রতিমণ বীজ তুলার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ৩ হাজার ৯শ’ টাকা। চলতি মৌসুমে তা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৪ হাজার ২শ’ টাকা।
সরেজমিনে ব্রহ্মপুত্র নদের নকলা উপজেলার চন্দ্রকোনা এলাকার চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, চলতি মৌসুমে গাছ থেকে তুলা সংগ্রহে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কৃষকরা। কথা হয় স্থানীয় মুনির আহমদ খোকনের সঙ্গে। তিনি জানান, চলতি বছর তিনি ২০ বিঘা জমিতে কার্পাস তুলার আবাদ করেছেন। এতে বিঘাপ্রতি তার খরচ হয়েছে প্রায় ১৭ হাজার টাকা।
এক বিঘা জমিতে তুলা উৎপাদন হয় ১২ থেকে ১৩ মণ। প্রতিমণ তুলা ৪ হাজার ২শ’ টাকা দরে তুলা উন্নয়ন বোর্ড কিনে নেয়। এতে বিঘাপ্রতি ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টাকার তুলা বিক্রি করা যায়। খরচ বাদ দিয়ে বিঘাপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা লাভ থাকে।
তুলা চাষি আরিফুজ্জামান রঞ্জু জানান, কয়েক বছর ধরে তুলা চাষ করে লাভবান হচ্ছেন তিনি। এ বছর ১০ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছেন। এতে লাভ বেশি পাওয়ায় কৃষকরা আগ্রহী হয়েছেন। তবে, তুলা চাষে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও দাম বাড়ালে অনুর্বর, নিষ্ফলা বা অনাবাদি অনেক জমিতে তুলা চাষ করে কৃষক পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করা সম্ভব।
একইভাবে স্থানীয় কৃষক শফিকুল ইসলাম ১২ বিঘা জমিতে, করিমুল ইসলাম ৪ বিঘা জমিতে, কনক মিয়া ১০ বিঘা জমিতে তুলা চাষ করেছেন। তারা জানান, অনুর্বর জমিতে কম পুঁজিতে নামমাত্র শ্রমে ও সরকারি সহযোগিতা পাওয়ায় উপজেলায় তুলা চাষের পরিমাণ ও চাষির সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের শেরপুর ইউনিট কর্মকর্তা মো. নুরুল আলম জানান, তুলার আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে উচ্চ ফলনশীল তুলার নতুন-নতুন জাতের উদ্ভাবন ও তা থেকে বীজ তৈরি করে মাঠ পর্যায়ের কৃষকদের মধ্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। আশা করছি, আগামী দিনে তুলা চাষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনেও ভূমিকা রাখবে।