ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৬ মার্চ ২০২৫, ২ চৈত্র ১৪৩১

ইসলামী গানের মাইলফলক: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ যেভাবে রচিত হলো

প্রকাশিত: ০৪:৫৬, ১৬ মার্চ ২০২৫

ইসলামী গানের মাইলফলক: ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’ যেভাবে রচিত হলো

ছবি: সংগৃহীত

যে দিনগুলোর কথা বলা হচ্ছে, তখনকার বাংলা সংগীতের আকাশে নতুন সূর্যের মতো উদিত হয়েছেন আব্বাসউদ্দীন আহমদ। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকের শুরুতে, কোচবিহার কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পারলেও, জীবনের অন্য এক পরীক্ষায় তিনি উত্তীর্ণ হতে চলেছেন। সংগীতের হাতছানি তাঁকে কলকাতায় টেনে নিল। কিছু অনুষ্ঠান ও গ্রামোফোন রেকর্ডের সুযোগ পেয়ে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তার আলোর রেখায় প্রবেশ করলেন। ১৯৩২ সালে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানির জন্য রেকর্ড করলেন দুটি গান—‘আজি শরতের রূপ দীপালি’ এবং ‘ওলো প্রিয়া নিতি আসি তব দ্বারে মন-ফুল-মালা নিয়া’।

সেই সময়েই তাঁর পরিচয় ঘটে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে। দুজনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো। নজরুলকে তিনি ‘কাজীদা’ বলে ডাকতেন। একে একে নজরুলের লেখা গান রেকর্ড করলেন, যার মধ্যে ‘বেনুকার বনে কাঁদে বাতাস বিধর’, ‘গাঙে জোয়ার এল, ফিরে তুমি এলে কই’ উল্লেখযোগ্য। জনপ্রিয়তা পেলেও যেন কোথায় একটা অপূর্ণতা অনুভব করতেন আব্বাসউদ্দীন।

ইসলামি গানের ভাবনা ও প্রথম প্রয়াস

সেই সময় বাংলার মুসলমান সমাজে কাওয়ালির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু আব্বাসউদ্দীনের মনে এলো এক নতুন ভাবনা—বাংলায় যদি ইসলামি গান তৈরি করা যায়! ভাবনাটি তিনি নজরুলের সঙ্গে ভাগ করে নিলেন এবং তাঁকে অনুরোধ করলেন ইসলামি গান লেখার জন্য। নজরুল প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত থাকলেও বললেন, গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল ইনচার্জ ভগবতীবাবুর অনুমতি নিতে হবে।

ভগবতীবাবু প্রথমে তীব্র আপত্তি করলেন। ছয় মাস পর একদিন সুযোগ বুঝে আব্বাসউদ্দীন আবার বিষয়টি তুললেন এবং শেষমেশ অনুমতি পেলেন। তিনি আনন্দিত হয়ে কাজীদার কাছে ছুটলেন। তখন নজরুল ইন্দুবালাকে গান শেখাচ্ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইন্দুবালাকে বিদায় দিয়ে নজরুল দরজা বন্ধ করে মাত্র আধঘণ্টায় লিখে ফেললেন—

“ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ।”

সঙ্গে সঙ্গে সুর সংযোজন করলেন এবং শিখিয়ে দিলেন আব্বাসউদ্দীনকে। পরদিন নজরুল লিখলেন—

“ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এল নবীন সওদাগর।”

মাত্র চার দিনের মধ্যেই গান দুটি রেকর্ড হলো। ঈদুল ফিতরের দুই মাস আগেই ঠিক হলো, এই রেকর্ড ঈদে বাজারে আসবে।

অভাবনীয় জনপ্রিয়তা ও গ্রামোফোন কোম্পানির সাড়া

ঈদের ছুটিতে কোচবিহারে গিয়ে ফিরে আসার পর, ট্রামে চড়তে গিয়ে আব্বাসউদ্দীন শুনতে পেলেন এক যুবক গুনগুন করছে—‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে’। চমকে গেলেন! গানটি তো এখনো বাজারে আসার কথা নয়! গড়ের মাঠে গিয়ে দেখলেন, একদল ছেলেও এই গান গাইছে।

কীভাবে গানটি এত জনপ্রিয় হলো, জানতে সোজা চলে গেলেন বিভূতিভূষণ সাহার দোকানে। বিভূতি তাঁকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “আমি সত্তর-আশি হাজার ছবি ছাপিয়েছি, ঈদের দিন বিতরণ করেছি, আর দেখো, তোমার দুই হাজার রেকর্ড এনেছি।”

আব্বাসউদ্দীন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে ছুটলেন গ্রামোফোন কোম্পানির রিহার্সেল রুমে। দরজা দিয়ে ঢুকতেই নজরুল তাঁকে বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “আব্বাস, তোমার গান কী যে হিট হয়েছে!” আব্বাসউদ্দীন হাসতে হাসতে বললেন, “তাহলে এক্সপেরিমেন্টের ধোপে টিকে গেছি, কেমন?”

ইসলামি গানের জয়যাত্রা

এরপর নজরুল একের পর এক ইসলামি গান লিখতে লাগলেন—‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়’, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়’, ‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি’—প্রতিটি গান বিপুল জনপ্রিয়তা পেল। আব্বাসউদ্দীনের একার পক্ষে চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছিল না। নতুন শিল্পীরা যেমন তকরীম আহমদ ও আবদুল লতিফ উঠে এলেন, কিন্তু তাতেও চাহিদা কমেনি।

এমনকি, হিন্দু গায়ক ধীরেন দাস হয়ে গেলেন গনি মিঞা, চিত্ত রায় হয়ে গেলেন দেলোয়ার হোসেন, গিরীন চক্রবর্তী হয়ে গেলেন সোনা মিঞা।

এদিকে কে মল্লিক, যিনি জনপ্রিয় শ্যামাসংগীত গায়ক, তিনিও নজরুলের ইসলামি গান গাইতে চাইলেন। কিন্তু ভগবতীবাবু আপত্তি করলেন, কারণ এতে হিন্দু ভক্তরা তাঁর শ্যামাসংগীত গ্রহণ করতে চাইবে না।

শেষ পর্যন্ত ভগবতীবাবুর মৃত্যুর পর নতুন রিহার্সেল ইনচার্জ হেমচন্দ্র সোম এলেন। তিনি সরল হাসি হেসে বললেন, “কে মল্লিক এতদিন কোম্পানির জন্য গেয়েছেন, এবার তিনি যদি আনন্দের জন্য ইসলামি গান গাইতে চান, তাতে ক্ষতি কী?”

সেদিন নজরুল আর কে মল্লিকের চোখে ছিল আনন্দাশ্রু। আর আব্বাসউদ্দীন আহমদ? তিনি ছিলেন বিজয়ীর মতো, এক নতুন ধারার জন্ম দিয়ে গর্বিত!

সূত্র : https://youtu.be/si2ZXx2kSVk?si=k3HRjjoRRaoeSyyU

আসিফ

×