
ছবি: সংগৃহীত
পটুয়াখালীর কলাপাড়ার সাগরপারের এই জনপদের একটি ভিন্ন দৃশ্যপটের গ্রামের নাম। সবজির গ্রাম নামেও রয়েছে ব্যাপক পরিচিতি। গ্রামটির বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। মাঠ-ঘাট বিল এমনকি বাড়ির উঠোন পর্যন্ত ফাঁকা নেই। রাস্তার দুই পাশ থেকে শুরু করে জমির আইলেও হয় কৃষি উৎপাদন। ১২টি মাস জুড়ে গ্রামটির ৯৫ ভাগ জমিতে সবজিসহ কোন না কোন কৃষিপণ্যের আবাদ হয়। প্রায় শতভাগ পরিবার কৃষিপণ্য আবাদে ব্যস্ত থাকেন। কোন জমি অনাবাদি রাখেন না। সকল কৃষি জমিতে আউশ-আমন-বোরোর আবাদ করেন। পাশাপাশি ব্যাপকহারে আবাদ করেন সবজির। হেন কোন ধরন নেই যে সেই পদ্ধাতিতে চাষাবাদ হয় না। কৃষকরা যেন আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের পসরা সাজিয়ে রেখেছেন।
শিশু-কিশোর-যুব থেকে শুরু করে বৃদ্ধ মানুষটাও কৃষি আবাদে ব্যস্ত সময় পার করছেন। নিরক্ষর থেকে শুরু করে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত ডিগ্রিধারী মানুষটিও করছেন বাণিজ্যিকভাবে কৃষি উৎপাদন। আয়ও করছেন জমিয়ে। কুড়ি থেকে পচিশ বছর আগের হাইলা-কামলা শ্রেণির মানুষ এখন সবজিসহ কৃষির আবাদ করে ভাগ্যের চাকা সচল করেছেন। পরিণত হয়েছেন গেরস্ত পরিবারে। সবুজের আস্তরণে ঢাকা চোখ জুড়ানো গ্রামটিতে না গেলে বোঝার উপায় নেই। কীভাবে অদম্য উদ্যমী এই মানুষগুলো গ্রামটিকে কৃষি উৎপাদনের মডেলে পরিণত করেছেন। সবাই কোমর বেধে কৃষি আবাদের লড়াই করছেন। সফল এই মানুষগুলো এখন অপর এলাকার জন্য প্রেরণা হয়ে উঠেছেন। আর এই গ্রামটির কৃষকের সুবিদার্থে সরকারের রয়েছে বিশেষ পরিকল্পনা।
যেখানে কলাপাড়া উপজেলার ২৪৭ টি গ্রামে ২৪৬টিতেই শতকরা ৫০-৯০ ভাগ পর্যন্ত কুষিজমি ধান চাষের পরে অনাবাদী পড়ে থাকে। মাঠ-ঘাট-বিল কৃষিজমি ধূসর বিবর্ণ অনাবাদী পড়ে থাকে। সেখানে কুমিরমারা গ্রামটি সবুজের আস্তরণে ঢাকা থাকছে ১২ মাস। এ এক ভিন্ন দৃশ্যপট। গ্রামটিকে এবছর কলাপাড়া উপজেলা পরিষদ থেকে কৃষি গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কলাপাড়া শহর থেকে কুয়াকাটাগামী সড়কের পাঁচ কিলোমিটার পরে পাখিমারা বাজারে নেমে পাখিমারা খালের ভাসমান সেতু পেরিয়ে পুবদিকেই গ্রামটির অবস্থান। এখন শুধু আশপাশের মানুষই নয় ঢাকা থেকেও মানুষ গ্রামটি ভিজিট করতে ভুলেন না।
সরেজমিনে না দেখলে আসল চেহারা বোঝার উপায় নেই। শুক্রবার বিকেলে কথা হয় গ্রামটির উদ্যমি কৃষক ৪৫ বছর বয়সী ইব্রাহিম হাওলাদার ও একই বয়সী দুলাল হাওলাদার ক্ষেত তৈরি করছিলেন। আধুনিকভাবে বর্ষা-জলোচ্ছ্বাস কিংবা জলাবদ্ধতার ধকলে না পড়েন এমনভাবে উচু করে ক্ষেত করছেন। মাটি কোপাচ্ছিলেন। দেখালেন প্রায় ২০ শতক জমিতে দুই পাশে সেচের পানি ধরে রাখার জন্য করা গভীর প্রশস্থ নালায় মিঠা পানি মজুদ করছেন। বোম্বাই মরিচের আবাদ করবেন। ওই জমি থেকে কয়েকদিন আগে আবাদ করেছেন করলা, পাতাকপি, ফুলকপি। বেচাবিক্রি শেষ করে আবার মরিচের আবাদ করবেন। জানালেন মাটি কাটা, ভরাট করা, ক্ষেত তৈরি করতে এবং বাঁশের মাচা জাল দিয়ে প্রস্তুত করতে অন্তত ৬০-৭০ হাজার টাকা খরচ হবে। অন্তত ১২ শ’ গাছ লাগাবেন। চৈত্রের শেষ থেকে বৈশাখের শুরতেই রোপন শেষ হবে। জৈষ্ঠ থেকে আষাঢ় মাসের শুরুতেই ফলন তুলে বিক্রির আশা ইব্রাহিম হাওলাদারের। অন্তত পাঁচ লাখ টাকা বিক্রির প্রত্যাশা তার। ঝড়-বন্যা কিংবা অতিবৃষ্টি থেকে রক্ষায় অনেক উচু করে তৈরি করেছেন ক্ষেতটি। মানুষগুলো যেন প্রাকৃতিক ঝুঁকি মোকাবেলার কৌশল রপ্ত করে কৃষি উৎপাদনের কাজ করছেন।
দুলাল হাওলাদার জানালেন, লেখাপড়া পঞ্চমে খ্যান্ত। কিন্তু কৃষিতে রয়েছে তার ব্যাপক কৃতিত্ব। দুই ভাই। বৃদ্ধ বাবা-মা, স্ত্রী এক সন্তান নিয়ে তাদের বসবাস। বসতভিটা ছাড়া কোন বাড়তি কৃষিজমি নেই। কুড়িটি বছর ধরে সবজির আবাদ করছেন। প্রতি তিন শতক জমি বছরে এক মণ ধানের বিনিময় রাখছেন। এভাবে ৫-৬ বিঘা জমি রেখে কৃষিকাজ করছেন। জানালেন, এ বছর সবজিতে লাভ হয়নি। দাম ছিল না। কিন্তু বোম্বাই মরিচে লাভ করে পুষিয়ে নিয়েছি। কৃষি উৎপাদন করে বছরে গড়ে এক দেড় লাখ টাকা লাভ করছেন তিনি। শত বছর বয়সী বাবাকে ঘুরেফিরে নিশ্চিন্তে চলার জন্য বলেছেন। নামাজ আর খাওয়া-দাওয়া করছেন তিনি। দুই ভাইয়ের কৃষি উৎপাদনে এখন খুব স্বস্তিতে আছেন তারা। বললেন, ‘স্যার সুখ-শান্তি বুঝি না, আল্লাহর ইচ্ছায় কষ্টে নাই। মোগো গ্রামে কোন মানুষ বেকার নাই। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সবাই কুষিকাজ করি ১২ মাস।’
গ্রামটির কৃষি উৎপাদনে বড় ভূমিকা রাখা কৃষক সুলতান গাজী, জাকির গাজী, আবুল কালামসহ সবাই জানালেন, তারা সবাই ১২মাস কোন না কোন ফসলের আবাদ করেন। তারা মাঠে থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। অধিকাংশ কৃষকের আধুনিক পদ্ধতিতে শেড করে চাষাবাদ করছেন। অতিবৃষ্টিতে গাছের ক্ষতি ঠেকাতে মালচিং পেপার ব্যবহার করছেন। শীতের সবজি শেষ না হতেই মানুষগুলো গৃষ্মকালীন সবজির আবাদে নেমেছেন। গ্রামটির অন্তত অর্ধশত পরিবার বর্ষকালীন জাতের সবজির আগাম আবাদের জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করছেন।
সুলতান গাজী জানালেন, দুই সন্তান হেমায়েত গাজী ও জাকারিয়া হৃদয়কে লেখাপড়া শেষ করে নিজের বাড়িতে সবজিসহ কৃষি আবাদের কাজ শিখিয়েছেন। চাকরির জন্য অপেক্ষা করেননি। তাঁদের ২০-২৫টি পরিবারের সদস্যরা চাকরি করতে পারে। বাকিরা সবাই ১২ মাস কৃষি উৎপাদনের কাজ করছেন। কুড়ি বছর আগে এই গ্রামে বলতে গেলে অভাবের যাতনায় কাহিল ছিলেন। অধিকাংশরা তিনবেলা খাবারের জন্য দুর্ভাবনা করতে হতো। অন্যের বাড়ির কামলা খুঁজতে হতো। এখন ভিন্ন চিত্র। সবাই ভালো মানসিকতা নিয়ে বিবর্ণ জমিতে সবুজের বিপ্লব ঘটিয়েছেন। জানালেন শীতকালে পুরো মৌসুমে এই গ্রাম থেকে প্রতিদিন গড়ে ১০-১৫ টন সবজি পাইকারি বাজারে গেছে।
আধুনিক চাষী জাকির গাজী জানালেন, প্রায় এক হাজার ভোটার অধ্যুষিত গ্রামটির শতকরা ৯৮ ভাগ পরিবার ১২ মাস কৃষি উৎপাদন করছেন। তারা সবসময় আগাম ফলন পেয়ে থাকেন। এমন পরিকল্পনা করেই কৃষির আবাদ করেন। কৃষকদের দেওয়া তথ্যমতে গ্রামটি থেকে সবজির মৌসুমে প্রতিদিন অন্তত ১০টন সবজি বিভিন্ন বাজারে পাইকারি চালান হয়। আর বর্ষায় প্রতিদিন ২০ টন বাজারে যায়। আর ধানতো আমনসহ তিন মৌসুম চাষাবাদ হয় গ্রামটিতে। জানালেন, গোটা উপজেলার চাহিদার প্রায় ৭৫ ভাগ যোগান যায় কুমিরমারা গ্রাম থেকে। গ্রামটির মানুষ যেন নিজের প্রয়োজনে নয় দেশের কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক ভূমিকা রাখছেন। ফলশ্রুতিতে গ্রামটি কৃষিকাজের জন্য মডেল গ্রামে পরিণত হয়েছে।
গ্রামটির কৃষকের রয়েছে একে অপরের প্রতি সূদৃঢ় বন্ধন। তারা নিজের অর্থে প্রতি বছর পাখিমারার খালটির সাথে সংযোগ স্লুইস খালের শেষ প্রান্তে নদীর লোনা পানির প্রবেশ ঠেকাতে বাঁধ দিয়ে থাকেন। কৃষিপণ্য বাজারে বিক্রির জন্য পাখিমারার খালে বাঁশের সাঁকোর পরে তিন দফা ভাসমান সেতু করেছেন। পুরানো আয়রন ব্রিজটি প্রায় দশ বছর ধরে বিধ্বস্ত দশায় পড়ে আছে। এটি তাদের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে জানালেন। এ ছাড়া যে পাখিমারার খালের মিঠা পানির উপর নির্ভরশীল গ্রামটির শত শত কৃষকের জীবন-জীবিকা। ফি বছর তাদের শত কোটি টাকার কৃষিপণ্য উৎপাদনের অবলম্বন খালটির মিঠা পানির রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন। কারণ খালটির একটি অংশ এখন পলির আস্তরণে ভরাট হয়ে খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে। এখন এটিই গ্রামবাসীর দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। তাদের প্রধান দাবি প্রয়োজনীয় মিঠাপানি সংরক্ষণের খালটি পুনর্খনন করা । এছাড়া দেশের কোটি কোটি টাকার কৃষিপণ্যের যোগান দেওয়া গ্রামটির একমাত্র সড়কটির দুই তৃতীয়াংশ কাদা মাটির। বর্ষায় মানুষ নৌকায় চলাচল করছে। কৃষিতে এতো বড় বিপ্লব গড়ে তোলা গ্রামটির মানুষের দাবি পাখিমারা খালে একটি গার্ডার ব্রিজ করে দেওয়া হোক। পাশাপাশি সড়কটি পাকাকরণ ও পাখিমারার খালটি দ্রুত খনন করে কৃষি উৎপাদনের এই ধারা অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দেওয়ার দাবি তাদের।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আরাফাত হোসেন জানান, কুমিরমারা গ্রামের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। ওখানকার কৃষকের স্বার্থে সরকারিভাবে ভূগর্ভস্থ সেচনালা করা হয়েছে। তবে আরো করা দরকার। তিনি জানালেন পটুয়াখালী জেলার জন্য কৃষি উৎপাদনের একটি হাব হিসেবে বিবেচিত রয়েছে গ্রামটি। ওখানকার কৃষকের প্রধান সমস্যা পাখিমারার খালটি পুনর্খনন করা। আর ইতমধ্যে খননের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। তাদের সকল সময় বিশেষ নজর থাকছে ওই গ্রামের কৃষকের প্রতি।
কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানান, পাখিমারা গ্রামকে ইতিমধ্যে কৃষি উৎপাদনের মডেল গ্রাম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কৃষককে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। গ্রামটির কৃষি উৎপাদনে উপজেলা পরিষদের বিশেষ দৃষ্টি রয়েছে। তাদের কৃষিপণ্য বাজারজাতের সুবিধায় ভ্যান সরবরাহ করা হয়েছে। উৎপাদিত সবজিসহ কৃষিপণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রির সুবিধার্থে কৃষক মার্কেট করা হয়েছে। তাদের প্রাণের দাবি পাখিমারার খালটি পুনর্খননের প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। খালের ওপর বিধ্বস্ত আয়রন ব্রিজের স্থানে একটি গার্ডার ব্রিজ করার পরিকল্পনা চুড়ান্ত হয়েছে।
আসিফ