
নওগাঁয় ৪ বছর আগে বিল আন্দাসুরা নামে একটি জলাশয় ইজারাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সাবেক জেলা প্রশাসক মো. হারুন অর রশিদ এর বিরুদ্ধে। ২০২১ সালে ইজারা হওয়া ওই জলমহালটি থেকে অন্তত কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে সরকার। জলমহাল ব্যবস্থ্যাপনা নীতি লঙ্ঘন করে ইজারা দেওয়ায় বঞ্চিত হয়েছে স্থানীয় মৎস্যজীবীরাও। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের পর সাবেক এ দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে সরকার চাইলেই ব্যবস্থ্যা নিতে পারে বলছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২১ সালের ১৪ই জানুয়ারি নওগাঁর মান্দা উপজেলার বিল আন্দাসুরাসহ ২টি জলমহাল ইজারার উদ্দেশ্যে বিজ্ঞপ্তি জারি করে জেলা প্রশাসন। যেখানে ২৫০ দশমিক শূণ্য ৯ একর আয়তনবিশিষ্ট বিল আন্দাসুরা জলমহালের সম্ভাব্য ইজারামূল্য নির্ধারন করা হয় ৩২ লক্ষ ২ হাজার ৫০০ টাকা। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা ১৪২৮ থেকে ১৪৩০ সন পর্যন্ত ৩ বছর মেয়াদে ইজারার জন্য প্রকৃত মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি সমূহের নিকট হতে সীলমোহরকৃত খামে দরখাস্ত আহবান করেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও জেলা জলমহাল ব্যবস্থ্যাপনা কমিটির সভাপতি মো. হারুন অর রশিদ। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী এ দরপত্র বিক্রি ও দাখিলে সময় বেঁধে দেওয়া হয় ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১২ই এপ্রিল পর্যন্ত। তবে এ সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ওই বছরের ১লা এপ্রিল সর্ব্বোচ্চ দরদাতা দেখিয়ে নওগাঁ সদর উপজেলার “দক্ষিণ গোয়ালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড” এর সভাপতি ফরহাদ হোসেন পিন্টুকে ৩২ লক্ষ ৫ হাজার ৫০০ টাকায় ৩ বছরের জন্য বিল আন্দাসুরা জলমহাল ইজারা দেয়া জেলা প্রশাসন। ভ্যাট ও আয়করসহ ইজারার প্রথম কিস্তি ১২ লক্ষ ৮২ হাজার ২০০ টাকা পরিশোধে সময় বেঁধে দেওয়া হয় ৭ কর্মদিবস।
জলমহাল ব্যবস্থ্যাপনা নীতি, ২০০৯ অনুযায়ী কোন জলমহাল ইজারার ক্ষেত্রে “জাল যার জলা তার” এই নীতির আলোকে প্রকৃত অর্থেই যারা মৎস্যজীবী পেশায় নিয়োজিত তাদের মাঝে জলমহাল ইজারা দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। এছাড়াও এতে সুষ্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে “লীজ গ্রহীতা কোন মৎসজীবী সংগঠন/সমিতি তাদের নামে জলমহাল কোন অবস্থ্যাতেই সাবলীজ অথবা অন্য কোনো ব্যক্তি/গোষ্ঠীকে হস্তান্তর করতে পারবে না। অন্য কোনো উপায়ে তা ব্যবহার করতেও পারবে না। যদি তা করে থাকেন তাহলে জেলা প্রশাসক লীজ বাতিলসহ জমাকৃত লীজের টাকা সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করবেন”। এতে আরও বলা হয়েছে, “জেলা জলমহাল ব্যবস্থ্যাপনা কমিটি মাঝে মাঝে সভা করে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের অনুকূলে যেসকল জলমহাল ইজারা দেওয়া রয়েছে, তা পরিবীক্ষণ করবেন ও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন”।
তবে অনুসন্ধ্যানে দেখা যায়, দক্ষিণ গোয়ালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামে ইজারা হওয়া এ জলাশয়ের বিষয়ে সমিতিটির কোনো সদস্যই অবগত ছিলেন না। সমিতিটির লাইসেন্সসহ যাবতীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে বিল আন্দাসুরা জলমহাল ইজারার উদ্দেশ্যে আবেদন করেছিলেন নওগাঁ শহরের সুলতানপুর মহল্লার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মো. আসাদুজ্জামান খান চৌধুরী। এ কাজে আসাদুজ্জামান’কে সহযোগীতা করেন দক্ষিণ গোয়ালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড সংলগ্ন এলাকা সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের গোয়ালী এলাকার বাসিন্দা জমির উদ্দীন। মূলত জমিরের মাধ্যমেই সিন্ডিকেট করে ওই ইজারার বিপরীতে অন্য কাওকে দরপত্র জমা দিতে না দিয়ে জলাশয়টি সাবলীজ মূলে হাতিয়ে নেন আসাদুজ্জামান খান চৌধুরী। এ সিন্ডিকেটে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো. হারুন অর রশিদের সম্পৃক্ততার অভিযোগও রয়েছে। আসাদুজ্জামান খান চৌধুরী জলমহালটি সাবলীজ মূলে ব্যবহার করছেন জেনেও তার বিরুদ্ধে কখনোই কোনো ধরনের ব্যবস্থ্যা নেয়নি জেলা জলমহাল ব্যবস্থ্যাপনা কমিটি। এতে জলমহাল ইজারা দেওয়ার উদ্দেশ্য লঙ্ঘন হওয়ায় বঞ্চিত হয়েছেন সাধারন মৎজীবীরা।
এবিষয়ে আরো জানতে সম্প্রতি সরেজমিন নওগাঁ সদর উপজেলার শিকারপুর ইউনিয়নের গোয়ালী গ্রামে গেলে “দক্ষিণ গোয়ালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড” নামে কোনো সংগঠনের কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ২০১০ সালে সমবায় অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন পাওয়া এ সমিতির নামে বিভিন্ন সময়ে বড় বড় জলাশয় ইজারা হলেও কখনোই এর সুফল পাননি সংগঠনটির মৎস্যজীবী সদস্যরা। অর্থ সংকটে নিজেদের অস্থ্যায়ী কার্যালয়টিও বর্তমানে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে।
গোয়ালী গ্রামের বাসিন্দা ও দক্ষিণ গোয়ালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সদস্য মৎস্যজীবী আব্দুল মালেক বলেন, শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকায় সভাপতি পিন্টুসহ আমরা কেউ জমিরের প্রতারণা বুঝতে পারিনি। লাইসেন্স নবায়নের নামে কিছু কাগজপত্রে জমির আমাদের থেকে স্বাক্ষর নিয়েছিলো। ওই জলাশয় ইজারা নেওয়ার বিপরীতে আমাদের সমিতি এক পয়সাও আর্থিক সুবিধা পায়নি। কত টাকায় ইজারা হয়েছে, সেটিও জানা নেই।
সমিতির আরেক সদস্য মৎস্যজীবী আনোয়ার হোসেন বলেন, পুরো সদর উপজেলায় যেসব মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি আছে, সবখানে গিয়ে নিজেকে অডিট অফিসারের লোক বলে দাবী করেন জমির। এরপর সমিতিগুলোর কাগজপত্র নিয়ে সে তার মতো করে বিভিন্ন সরকারি কাজে ব্যবহার করে। বিনিময়ে অডিটের বিপরীতে কোনো টাকা নেন না জমির। তবে আমাদের লাইসেন্স কি কাজে ব্যবহার হয়, সেটি কখনো জানা যায় না। এসব করেই জমির আজ মৎস্যজীবী থেকে লাখ লাখ টাকার মালিক বনে গেছে।
দক্ষিণ গোয়ালী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সভাপতি ফরহাদ হোসেন পিন্টু বলেন, আমাদের লাইসেন্স ব্যবহার করে জলমহাল ইজারা পাওয়ার পর সেটি সাবলীজ হিসেবে আরেকজনের কাছে বিক্রি করতে একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর নেন জমির। এরপর সেটি কীভাবে কে ব্যবহার করেছে, খোঁজ নেওয়ার সুযোগ হয়নি। দীর্ঘ যুগ ধরে মৎসজীবী পেশায় নিয়োজিত থাকার পরেও এসব দুর্নীতির কারণে আমাদের জীবনমানে উন্নয়ন ঘটছে না।
এ সিন্ডিকেটে জড়িত জমির উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলতে সরাসরি গোয়ালী বাজার এলাকায় গেলে তিনি বলেন, বিল আন্দাসুরা জলাশয়ের ইজারামূল্য বেশি হওয়ায় কেউ দরপত্র কিনতে আসছিলেন না। ওইসময়ে তৎকালীন জেলা প্রশাসক নিজে আমাকে ডেকে জলাশয়টি ইজারা দিয়েছিলেন। সেই মোতাবেক জলাশয়টি ইজারা নিয়ে আমরা নিজেরাই সেখানে মাছ চাষ করেছি। এখানে কাওকে সাবলীজ দেওয়ার অভিযোগটি সঠিক নয় বলে দাবী করেন তিনি।
তবে সিন্ডিকেট করে জলাশয় ইজারা পাওয়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে ব্যবসায়ী মো. আসাদুজ্জামান খান চৌধুরী বলেন, ইজারা বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ার পর ওই সময়ে মান্দা থেকে কয়েকজন দরপত্র জমা দিতে এসেছিলো। নিয়ম অনুযায়ী নিকটবর্তী কেউ আবেদন করলে তারা অগ্রাধিকার পাবেন। বিষয়টি জানা মাত্রই দরপত্রে অংশ নিতে আসা প্রত্যেকের সঙ্গে সমন্বয় করেছি। তাই সেখানে আমি ছাড়া অন্য কেউ অংশগ্রহন করতে পারেননি। জলমহাল ইজারা নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব সিন্ডিকেট হয়েই থাকে। এতে দোষের কিছু নেই।
তিনি বলেন, জলমহালটি সাবলীজ নেওয়ার পর টানা এক বছর আমি নিজে সেখানে বিনিয়োগ করেছি। এক পর্যায়ে নগদ টাকার সংকটে আবারো আরেক পক্ষের কাছে জলমহালটি সাবলীজ দিয়েছি। ৩য় পক্ষের কাছে সাবলীজ দেওয়ার পর কিছু টাকা পেলেও পুরোপুরি টাকা হাতে পাইনি। তাই বাধ্য হয়ে আদালতে মামলাও করতে হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, তৎকালীন জেলা প্রশাসক হারুন অর রশিদ নামমাত্র ইজারা মূল্যে বিল আন্দাসুরা জলমহাল ইজারা দিয়েছিলেন। বিষয়টি সাবেক জেলা প্রশাসক গোলাম মওলার নজরে এলে তিনি পরবর্তী সনে জলমহালটি ছয় বছর মেয়াদে উন্নয়ন প্রকল্পে ইজারা দেন। এরপর থেকে মান্দা উপজেলার সোনাপুর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড প্রতি বছর ওই জলাশয়ের বিপরীতে ৫০ লক্ষ ৮ হাজার ৫৯৪ টাকা ইজারা মূল্য পরিশোধ করছেন। এর সঙ্গে তাকে বাড়তি ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ৫ শতাংশ আয়কর গুনতে হচ্ছে। এ থেকেই প্রমাণিত সেখানে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক হারুন অর রশিদ স্বেচ্ছাধীন তহবিলে (এলআর ফান্ড) মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে জলাশয়টি ইজারা দিয়েছিলেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাবেক জেলা প্রশাসক হারুন অর রশিদ বলেন, জেলা প্রশাসক হিসেবে থাকা অবস্থ্যায় স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করেছি। কখনোই কোনো ধরনের দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেইনি। ওই জলমহাল সম্পর্কে আপাতত মনে করতে পারছি না। পরবর্তীতে কীভাবে ইজারামূল্য বেড়েছে, সেটি আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নওগাঁর জেলা প্রশাসক আব্দুল আউয়াল বলেন, জেলায় ইতোপূর্বে ইজারাকৃত জলমহালগুলোর বেশিরভাগই হাতবদল হয়েছে। এখানে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের ইজারায় কখনোই অংশগ্রহন করতে দেয়া হতো না। এতে মৎস্যজীবীরা বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি সরকারের কাঙ্খিত রাজস্ব আদায় হয়নি। যেহেতু সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব বঞ্চিত হয়েছে, তাই বিগত সময়ে যারা এই দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন চাইলেই তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থ্যা নিতে পারে।
মুমু