ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতীয় প্রভাব, স্বাধীনতার মুখোশে পরাধীনতার শৃঙ্খল :জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা শিশির

প্রকাশিত: ১৩:৩১, ১৪ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ১৪:৩২, ১৪ মার্চ ২০২৫

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে ভারতীয় প্রভাব, স্বাধীনতার মুখোশে পরাধীনতার শৃঙ্খল :জাতীয় নাগরিক পার্টির নেতা শিশির

ছবি:সংগৃহীত

একটি দেশের গণমাধ্যম তার চেতনার দর্পণ, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কিন্তু যখন সেই দর্পণে প্রতিবিম্বিত হয় অন্য রাষ্ট্রের স্বার্থ, তখন গণমাধ্যম আর স্বাধীন থাকে না, হয়ে ওঠে এক অভিনব উপনিবেশ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও, বাস্তবে তা কতটা ছিল, সেটাই প্রশ্নবিদ্ধ। এটি কি সত্যিই স্বাধীন ছিল, বর্তমানেও ভারতের প্রভাব থেকে কতটুকু মুক্ত হয়েছে, নাকি কেবল এক অলীক প্রতিশ্রুতি, এক চতুর মোহজাল?

আমাদের জানতে হবে গণমাধ্যমের ওপর ভারতীয় প্রভাব কতটুকু? গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম এমন এক প্রবণতার শিকার হয়েছিল, যা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বহির্বিশ্বের শক্তিগুলো—বিশেষত ভারত—বাংলাদেশের গণমাধ্যমকে যেন এক প্রকার ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করত। সেই ভারতের এজেন্টগুলো এখনও অধিকাংশ গণমাধ্যমে বহালতবিয়ত আছেন।

সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে সত্য প্রকাশ করা। কিন্তু বাস্তবতা ছিল, অনেক গণমাধ্যম নিজ দেশের স্বার্থের বদলে অন্য রাষ্ট্রের গোপন এজেন্ডা লালনপালন করত। কথিত স্বাধীন জার্নালিজম তখন 'আওয়ামীলিজম', 'বাকশালিজম', কিংবা 'ইন্ডিয়ালিজমের' আশ্রয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। যারা সত্য বলতে চাইত, তাদের কণ্ঠরোধ করা হতো, সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে বন্দি করা হয়েছিল এক অদৃশ্য কারাগারে। দেশপ্রেমিক সাংবাদিকদের নামে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলা দিয়ে জেলে ভরা হয়েছে, দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে অসংখ্য লড়াকু কলম সৈনিককে। সাংবাদিকতার নামে যখন একপাক্ষিক প্রচারণা চালানো হতো, তখন সেটি আর সাংবাদিকতা থাকত না, হয়ে উঠত নিছক প্রোপাগান্ডার সরঞ্জাম।

সাংবাদিকদের জন্য গত ১৭ বছর ছিল এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত কমপক্ষে ৪১ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন, অসংখ্য সাংবাদিক নির্যাতিত হয়েছেন। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই অন্তত ১৯৮ জন সাংবাদিক হামলা, নির্যাতন ও মামলার শিকার হয়েছেন। শুধু জুলাই বিপ্লবে ৫ জন সাংবাদিককে শহীদ করেছে ভারতীয় আশীর্বাদপুষ্ট খুনি হাসিনা। 

বিশেষত, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) ছিল সাংবাদিকদের জন্য এক দুঃস্বপ্ন। এই আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করা হয়েছে। এমনকি সাংবাদিকদের পেশাগত কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক শক্তির দ্বারা হামলার মুখে পড়তে হয়েছে।

২০২০ সালে সাংবাদিক মোজাক্কিরকে গুলি করে হত্যা করা হয়।২০২২ সালে যশোরে সাংবাদিক জামাল উদ্দিনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০২৩ সালে সাগর-রুনি হত্যা মামলা ১১ বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। গত এক দশকে অন্তত ১,২০০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যার মধ্যে অধিকাংশই ছিল সরকারবিরোধী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে।

২০২৪ সালে ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম 'রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ' একটি বিস্ময়কর তথ্য প্রকাশ করেছিল। দেখা গিয়েছে, ভারতীয় ৭২টি গণমাধ্যম বাংলাদেশ সম্পর্কে ভুয়া তথ্য প্রচার করেছিল। বিষয়গুলো কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না; বরং এটি এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ ছিল।

উদাহরণস্বরূপ: ইসকনের বাংলাদেশ শাখা নিয়ে প্রচারিত চারটি অপতথ্য। সেনাবাহিনীকে নিয়ে ছয়টি, পুলিশকে নিয়ে দুটি, বিমান বাহিনীকে নিয়ে একটি অপতথ্য। দুর্গাপূজা উপলক্ষে চারটি ভুয়া তথ্য প্রচার এবং চট্টগ্রামের হাজারী গলির সহিংসতা নিয়ে তিনটি মিথ্যাচার।

এভাবে একের পর এক অপপ্রচার ছড়িয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশের জনমনে এক ধরনের মানসিক দাসত্বের অনুভূতি তৈরি করতে চেয়েছিল। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এসব অপপ্রচার ছড়ানোর একটি সুসংগঠিত প্রচেষ্টা চলছিল।

গণমাধ্যমের পাশাপাশি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেও ভারতীয় আধিপত্য তখন গভীরভাবে বিস্তৃত ছিল। ভারতীয় টেলিভিশন সিরিয়াল, সিনেমা, সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। সংবাদপত্র বা টেলিভিশন খুললেই ভারতীয় সিনেমা ও সিরিয়ালের খবর প্রধান শিরোনামে থাকত, যেন এ দেশেও এক ধরনের ‘ ভারতীয়  সংস্কৃতির’ নীরব প্রচার চলত। কিন্তু এতে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মূল্যবোধ ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

তথ্যযুদ্ধের মাধ্যমে ভারতের যে ‘সফট পাওয়ার’ প্রভাব বিস্তার করা হচ্ছিল, তা কেবলই সাংস্কৃতিক বিনিময় ছিল না; বরং এক প্রকার ‘সাংস্কৃতিক দখলদারিতা’ ছিল।

বর্তমানেও ভারতের প্রভাব যে পুরোপুরি মুক্ত হয়েছে, তা বলা যাবে না। অধিকাংশ গণমাধ্যমের মালিক, সম্পাদক, সাংবাদিক ভারতের পারপাস সার্ভ করেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু পরিবর্তনের আভাস মিলেছে, তবু সংবাদমাধ্যমের অভ্যন্তরে ভারতের দালালদের অবস্থান এখনো বহাল রয়েছে। দুনিয়া কাঁপানো জুলাই বিপ্লবে সরকার বদলালেও এই অবস্থা কতটা পরিবর্তিত হবে, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

তাহলে পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় কী? বাংলাদেশের জাতীয় গণমাধ্যমকে যদি সত্যিকার অর্থে স্বাধীন করতে হতো, তবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে:
গণমাধ্যমের মালিকানা ও বিদেশি বিনিয়োগের উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছ নীতিমালা তৈরি করতে হবে। স্বতন্ত্র গবেষণা দল গঠন করে ভারতীয় গণমাধ্যমের অপপ্রচার রুখতে হবে। ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্মগুলোর কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করতে হবে।

গণমাধ্যমে বিদেশি বিনিয়োগ ও অর্থায়নের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখতে হবে, যাতে গণমাধ্যম সরাসরি অন্য দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার না হয়ে ওঠে।  যে কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক প্রভাবমুক্ত সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে। সাংবাদিকদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে হবে, যাতে তারা নির্ভয়ে সত্য প্রকাশ করতে পারেন।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অতীত পরিস্থিতি যেন এক ‘নব্য উপনিবেশবাদী’ বাস্তবতা ছিল। কাগজে-কলমে স্বাধীন গণমাধ্যমের কথা বলা হলেও, বাস্তবিক অর্থে এই স্বাধীনতা তখন প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। বর্তমানেও অধিকাংশ গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ এখনও ভারতের প্রভাবমুক্ত হয়নি। এটি শুধু সংবাদ পরিবেশনে নয়, বরং নীতি নির্ধারণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক দখলদারিতেও স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।

জনগণের প্রত্যাশা ছিল, একদিন গণমাধ্যম সত্যিকারের স্বাধীন হবে, ভারতীয় দালালদের হাত থেকে মুক্তি পাবে। কিন্তু যদি সেই মুক্তি না আসে, তাহলে হয়তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করবে, "তোমরা কি সত্যিই সাংবাদিক ছিলে, নাকি ভারতীয় লেজুড়বৃত্তির অংশ?"

জয়নাল আবেদীন শিশির, যুগ্ম সদস্য সচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি ।

আঁখি

×