
পরচুলা তৈরির কারখানায় কর্মব্যস্ত নারী শ্রমিকরা
পাবনার চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের কাটাখালির প্রত্যন্ত গ্রাম মস্তালীপুরে ব্যতিক্রমী পরচুলা তৈরির কারখানা গড়ে তোলেন দুই বোন তাজনাহার হাসি ও আরজিনা আক্তার খুশি। ২০১০ সালে শুরুতে ১০ জন কর্মী নিয়ে যাত্রা শুরু হয় কারখানাটির। নাম দেওয়া হয় হেয়ার ফ্যাশন।
পরচুলা তৈরির কারখানা স্থাপন করে দৃষ্টান্ত গড়েছেন আত্মপ্রত্যয়ী দুই বোন হাসি ও খুশি। সংগ্রামী জীবনে বেকারত্বের অভিশাপ ঘুচিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থান করেছেন প্রত্যন্ত গ্রামের অন্তত দুই শতাধিক নারীর। কঠোর পরিশ্রমী এই দুই বোনের কারখানার পণ্য এখন রপ্তানি হচ্ছে ভারত, পাকিস্তানসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশেও। দরিদ্র জীবনের গল্প শেষে হাসি, খুশি দুই বোন এখন জেলার অন্যতম সফল উদ্যোক্তা।
সরজমিনে হেয়ার ফ্যাশন পরচুলার উদ্যোক্তা হাসি ও খুশির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান, এক সময় খুশির স্বামী কাজ করতেন পরচুলার কারখানায় সঙ্গে কাজ করতেন খুশিও। ২০১০ সালে তার কাছ থেকেই পরচুলা তৈরির পরিকল্পনা নেন দুই বোন হাসি খুশি। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ দেন গ্রামের কয়েকজন নারীকে। শুরু করেন পরচুলা তৈরি। এরপর আর থেমে থাকতে হয়নি তাদের। ক্রমেই বেড়েছে কারখানার পরিসর। কারখানাটিতে কাজ করেন গ্রামের দুই শতাধিক নারী শ্রমিক।
আরজিনা আক্তার খুশি বলেন, আমার স্বামী ঢাকায় পরচুলা তৈরির কাজ করতেন। তার সঙ্গে আমিও এ কাজ করতাম। কিছুদিন পর গ্রামে ফিরে এসে আমার ছোট বোন হাসিকে সঙ্গে নিয়ে এই কারখানা গড়ে তুলেছি বাড়ির আঙিনায়।
খুশি আরও জানান, চুল তৈরির জন্য প্রথমে ঢাকায় পরচুলা বিক্রেতাদের কাছ থেকে প্রতি কেজি তিন হাজার টাকায় চুল কিনে নিয়ে আসা হয়। সেই চুল ব্লিচিং, শ্যাম্পু, গ্লিসারিন, কন্ডিশনার দিয়ে পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হয়। তারপর চুল বান্ডিল করা হয়। এরপর নেটের ক্যাপে সুচ দিয়ে চুল বুনিয়ে পরচুলা তৈরি করা হয়।
একটি পরচুলা তৈরিতে সময় লাগে তিন থেকে চার দিন। প্রতিটি পরচুলা তৈরি করে মেয়েরা (শ্রমিক) মুজুরি পায় ৫০০ টাকা। ঢাকায় প্রতিটি পরচুলা পাইকারি বিক্রি হয় ১ হাজার ৭০০ টাকা থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত।
তাজনাহার হাসি জানান, সফলতার জন্য কারো মুখাপেক্ষী না থেকে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, ধৈর্য ও একাগ্রতায় চেষ্টা করলেই সম্ভব হয়। নারী বলে পিছিয়ে থাকার এখন কোনো সুযোগ নেই। তাদের তৈরি পরচুলা দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহের পাশাপাশি ভারত, আজারবাইজান, মালয়েশিয়া, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়। তারা এখন এই ব্যবসায় সফল ও প্রতিষ্ঠিত।
মস্তালীপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী খালেদা খাতুন বলেন, এই কাজের মাঝে আমি বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন খুঁজে পেয়েছি। এখানে কাজ করে মাসে তিন থেকে চার হাজার টাকা করে আয় করছি। এই টাকা দিয়ে স্বামীর সংসারে কিছুটা সহযোগিতা করতে পারছি।
কারখানার কর্মী কলেজ ছাত্রী আল্পনা খাতুন বলেন, অবসর সময়ে এই কারখানায় কাজ করি। পড়াশোনার পাশাপাশি আয় হচ্ছে। এই আয় দিয়ে নিজের এবং বাবা-মা’র সংসারের চাহিদা পূরণে কিছুটা সহায়ক হচ্ছে।
রেশমা সুলতানা ও শারমিন খাতুন বলেন, আগে গ্রামে মেয়েদের বাল্যবিবাহ খুব বেশি ছিল। মেয়েরা চাইলেও খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারত না। হাসি খুশি আপার কারখানায় কাজের সুযোগ পাওয়ায় এখন যেমন নিজেদের লেখাপড়ার খরচ যোগানো যাচ্ছে, পরিবারকেও সহযোগিতা করা যাচ্ছে। ফলে, বাল্যবিবাহ এখন প্রায় নেই বললেই চলে।
স্থানীয় সমাজকর্মী ইশারত আলী বলেন, দুই বোনের এই উদ্যোগ আমাদের পুরো গ্রামকে বদলে দিয়েছে। এলাকার গরিব নারীরা আত্মনির্ভরশীল হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন। পরচুলা কারখানায় কাজ করে স্বাবলম্বী হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছেন গ্রামের সাধারণ হতদরিদ্র নারীরা। স্কুল ও কলেজের মেয়েরা লেখাপড়ার পাশাপাশি এ কাজ করে লেখাপড়া চালানোর খরচ চালাচ্ছেন নারী শিক্ষার্থীরাও।
নারীদের আর্থিক সচ্ছলতা সমাধান দিয়েছে গ্রামের অনেক সামাজিক সমস্যারও। সামাজিক পারিবারিক নির্যাতন কমে গেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। আমরা গ্রামবাসী হাসি-খুশির জন্য গর্ব করি। তাদের কারখানার রাস্তাটি পাকাকরণ হলে, গ্রামের আরও নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।