ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

গ্রেপ্তার দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর তথ্য

আশ্রিতাকে শ্লীলতাহানি করতে গিয়ে খুন সাবেক উপাধ্যক্ষ সাইফুর

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৩১, ১২ মার্চ ২০২৫

আশ্রিতাকে শ্লীলতাহানি করতে গিয়ে খুন সাবেক উপাধ্যক্ষ সাইফুর

আশ্রয় দেওয়া নারীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে খুন হন সাইফুর রহমান

রাজধানীর উত্তরখান এলাকায় নিজ বাসায় আশ্রয় দেওয়া নারীকে ধর্ষণ করতে গিয়ে খুন হন হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভূঁইয়া। এ ঘটনার গ্রেপ্তারকৃত রুপা ও নাজিম নামে এক দম্পতিকে জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর এ তথ্য বেরিয়ে আসে। বুধবার রাজধানীর ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে উত্তরা বিভাগের ডিসি মুহিদুল ইসলাম এ তথ্য জানান।
পুলিশ বলছে, গ্রেপ্তারকৃত রুপা ও নাজিম দম্পতিকে সহযোগিতার কথা বলে উত্তরখানের সেই বাসায় নেওয়া হয়েছিল রোজার আগেরদিন। সেই বাসায় থাকাকালীন রুপার শরীরে বিভিন্ন সময়ে হাত দিতেন উপাধ্যক্ষ সাইফুর রহমান। ঘটনার রাতে রুপাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন তিনি। আর সেই দৃশ্য পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্বামী দেখে ফেলেন। এ সময় স্ত্রীর সঙ্গে এমন আচরণ দেখে সহ্য করতে পারেননি নাজিম। এক পর্যায়ে রান্নাঘর থেকে বটি এনে সাইফুলের মাথায় ও শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপ দেন।

এতে গুরুতর আহত হয়ে সাইফুর রহমানের মৃত্যু হয়। ঘটনার পর রহস্য উন্মোচনে কাজ শুরু করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। পরে গোপন তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে ফরিদপুর থেকে রুপা-নাজিম দম্পতিকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ঘটনার সূত্রপাত ॥ ডিসি মুহিদুল জানান, মোবাইলে পরিচয়ের সূত্রে ছয়-সাত মাস আগে বিয়ে করেন রুপা ও নাজিম। নাজিমের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা এলাকায়। আর রুপার বাড়ি ফরিদপুরের সালথা উপজেলায়। তারা মূলত রংপুর থেকে লালমনি এক্সপ্রেসে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে নামেন। এরপর ফরিদপুর যেতে চেয়েছিলেন। তারা অপেক্ষা করছিলেন স্টেশনের আট নম্বর প্ল্যাটফর্মে। নাজিম এক পর্যায়ে তার স্ত্রীকে বলেন আমি নাস্তা নিয়ে আসছি তুমি ওয়েট কর।

এরই মাঝে রুপা ঘুমিয়ে পড়ায় ব্যাগ থেকে মালামাল হারিয়ে যায়। পরে ঘুম ভাঙলে উঠে দেখে তার ব্যাগ ও পার্স হারিয়ে গেছে। এ সময় রুপা পাশে থাকা এক মহিলাকে ডাকলে পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া সাইফুর রহমান কাছে গিয়ে বলেন, তুমি কি আমাকে ডেকেছো ? এ সময় রুপা বলে না, আমি আপনাকে ডাকিনি। তখন সাইফুর রহমান বলেন, তোমার কী হয়েছে ?

আর তোমার সঙ্গে কেউ আছে কি না। রুপা জানায়, তার স্বামী সঙ্গে আছে। সে নাস্তা আনতে গেছে। ওই সময় আরও কথা হয় তাদের মাঝে। এরইমধ্যে নাজিম আসেন। নাজিমকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী কর ? নাজিম জানায়, তারা তেমন কিছু করে না। এ কথা শুনে সাইফুর রহমান তাকে বলেন, তোমরা আমার সঙ্গে চলো।

আমার ছয়তলা বাড়ি আছে, গাড়ি আছে। তোমরা আমার বাসায় থাকবে। ড্রাইভারি শিখে তুমি আমার গাড়ি চালাবে। আমার বাসাতেই তোমরা থাকবে। এই কথা বলে তাদের একটি রিক্সায় তুলে পরে বাসে এবং অটোতে করে সেই বাসায় নিয়ে যান উপাধ্যক্ষ সাইফুর রহমান।  
ডিসি জানান, যখন সে বাসাতে গিয়ে সাইফুর রহমান ঘরের তালা খুলছিলেন সে সময় রুপা তাকে জিজ্ঞাসা করেন আপনি তো বলেছেন, আপনার স্ত্রী সন্তান আছে। তাহলে তারা কোথায়। তখন তিনি বলেন, তারা পাশের বাসায় বেড়াতে গেছে। ৫-৬ দিন থাকবে এরপর চলে আসবে। এসব হচ্ছে রোজার আগের দিনের ঘটনা। পরেরদিন রোজা শুরু হবে। 
গ্রেপ্তারকৃত রুপা যা বলেন ॥ পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃত রুপা দাবি করে, সেই বাসায় থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে সাইফুর রহমান তার শ্লীলতাহানি করেছেন। তাকে নানাভাবে যৌন নির্যাতন করতেন। সাইফুর রহমান যখন বাসার বাইরে যেতেন তখন ঘরের প্রধান দরজা বন্ধ করে দিয়ে যেতেন। তিনি রুপাকে বলতেন তুমি বারান্দায় যাবে না। তুমি যদি এসব কথা তোমার স্বামীকে বলো তবে তাকে মেরে ফেলব। রুপার ভাষ্য, তিনি তার স্বামীকে অনেক ভালোবাসেন। তাই স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে তিনি এসব কিছুই তাকে বলেননি।
সেই রাতে যা ঘটেছিল ॥ গ্রেপ্তারকৃত নাজিম ও রুপার বরাত দিয়ে উত্তরা বিভাগের ডিসি মুহিদুল ইসলাম জানান, বাসাটিতে অন্য রুমে তেমন খাট-পালঙ্ক না থাকায় তারা এক রুমে ঘুমাতেন শুরুর দিন থেকে। মাঝে ঘুমাতেন নাজিম। গত ৯ মার্চ রাতে তারা একসঙ্গে ঘুমিয়েছিলেন। ঘুমের মাঝে সাইফুর রহমান তার স্বামীর গায়ের ওপর দিয়ে রুপার গায়ে হাত দিয়েছিলেন।

একপর্যায়ে সাইফুর রহমান উঠে গিয়ে রুপাকে ঝাপটে ধরে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। তাদের মাঝে ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে রুপার স্বামী নাজিমের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম থেকে উঠে নাজিম উপাধ্যক্ষকে বলতে থাকেন তুমি তাকে ছেড়ে দাও না হলে আমি তোমাকে মেরে ফেলব। তখন নাজিম পাশে থাকা রান্নাঘর থেকে বটি নিয়ে আসেন। ওই সময়ও সাইফুর রহমান রুপার গায়ের ওপরেই ছিলেন। ওই অবস্থায় নাজিম তার মাথায় কোপ দেন।

সাইফুর রহমান তা ঠেকানোর চেষ্টা করলে তার হাতের অনেক জায়গায় কোপ দেন নাজিম। এক পর্যায়ে সাইফুর রহমান নিজেকে রক্ষার জন্য দৌড় দিয়ে বাথরুমে ঢুকে পড়েন। এরপর বাথরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা পার্স, ব্যাগ ও চাবির গোছা নিয়ে তারা চলে যান। তারপর সাইফুর রহমান প্লাস্টিকের দরজা ভেঙে বের হন। পরে চিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন ছুটে এসে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার আধা ঘণ্টা পর তার মৃত্যু হয়। 
রুপার ওপর নির্যাতন চলছিল জেনেও তারা কেন বাসা ছাড়লেন না এমন প্রশ্নের জবাবে ডিসি মুহিদুল বলেন, তাদেরকে বাসা থেকে বের হতে দিতেন না সাইফুর রহমান।  
রুপাকে ফোর্স করে বলত সেখানেই থাকতে হবে। না হলে তার স্বামীকে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন। ফলে ভয়ে কাউকে কিছু বলত না রুপা। রুপা ও নাজিম খুব বেশি শিক্ষিত তাও নয়। তাদের বয়সও ২০-২২ এর মধ্যে? তাদের কাছে মোবাইলও ছিল না।
১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি ॥ এদিকে বুধবার সাবেক উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভূঁইয়া হত্যা মামলায় গ্রেপ্তারকৃত দম্পতি রুপা বেগম ওরফে জান্নাত ও নাজিম হোসেন আদালতে দোষ স্বীকার করে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। এর আগে সকালে তাদেরকে আদালতে হাজির করা হয়।

এ সময় তারা ঘটনার দায় স্বীকার করে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দিতে সম্মত হলে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উত্তরখান থানার উপ-পরিদর্শক জাহিদুল হাসান তাদের জবানবন্দি রেকর্ড করার আবেদন করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ইসরাত জেনিফা জেরিনের আদালত রুপার এবং আরেক মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলমের আদালত নাজিমের জবানবন্দি রেকর্ড করেন। এরপর তাদেরকে কারাগারে পাঠানো হয়।
এদিকে মামলা সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ মার্চ সকালে রাজধানীর উত্তরার উত্তরখান থানা এলাকার পুরানপাড়ার একটি বাসার চতুর্থ তলার ফ্ল্যাট থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজের সাবেক উপাধ্যক্ষ মোহাম্মদ সাইফুর রহমান ভূঁইয়াকে। পরে প্রতিবেশীরা বাথরুমের দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ১১ মার্চ নিহতের ভাই মোহাম্মদ লুৎফুর রহমান ভূঁইয়া বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন।

×