
ড. মো. বাহানুর রহমান
দুগ্ধবতী গাভীর ওলান প্রদাহের প্রতিষেধক ‘ম্যাসটাইটিস’ ভ্যাকসিন আবিষ্কার করেছেন ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞানী। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো. বাহানুর রহমানের দাবি এই ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ফলে দুগ্ধ খামারিরা উপকৃত হবেন। বাড়বে দুধের উৎপাদন। জোগান মিলবে প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদার।
ড. রহমানের দাবি, সরকারি উদ্যোগে ভ্যাকসিনটির উৎপাদন ও বাজারজাত করা হলে লাভবান হবেন খামারিরা। এরই মধ্যে এই ভ্যাকসিনটি মাঠ পর্যায়ের গাভীর খামারে সফলভাবে প্রয়োগ করে এর সুফল মিলেছে বলে দাবি করেন বিজ্ঞানীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত ম্যাসটাইটিস ভ্যাকসিনটি সম্পর্কে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরকে অবহিত করা হয়েছে। যদিও অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিজ্ঞানীদের আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদন ও বাজারজাত সম্পর্কে কোনো উদ্যোগ গ্রহণের কথা জানানো হয়নি। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর থেকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত দেশের যেকোনো প্রতিষ্ঠান ম্যাসটাইটিস’ ভ্যাকসিনটির উৎপাদন ও বাজারজাত করতে পারবে।
ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের সঙ্গে জড়িত বিজ্ঞানীরা জানান, আমাদের দেশের দেশী গাভী প্রতিটি এক থেকে তিন লিটার পর্যন্ত দুধ দিয়ে আসছে। তবে শংকর জাতের গাভী প্রতিটি ২০ থেকে ৩০ লিটার দুধ দিয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে এসব গাভী ওলান প্রদাহের ফলে দুধ দেওয়ার পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যায়। কারণ হিসেবে বলা হয় গাভী বাচ্চা প্রসবের পর ওলানে দুধের প্রবাহ কিছুটা বাড়লেও সংক্রমণের কারণে এক পর্যায়ে কমে যায়।
বিজ্ঞানীদের দাবি, বাচ্চা প্রসবের পর এসব গাভী গোবর, প্রস্রাব ও নোংরা ধূলো মাটি মিশ্রিত জায়গায় শুয়ে থাকার কারণে বিভিন্ন সময় ওলান ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমিত হয়ে দুধের প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করে। এ থেকে প্রতিটি গাভীর দুধের উৎপাদন অনেকাংশেই কমে যায়।
এরকম অবস্থায় আমদানি করা অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করেও গাভীর ওলান প্রদাহ নিরাময় করা যাচ্ছিল না। এছাড়া গাভীর ওলান সংক্রমিত হওয়ার কারণে উৎপাদিত দুধের সঙ্গে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মিশে মানব দেহেরও ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এই দুধ খেয়ে চর্ম, ডায়রিয়াসহ ফুড পয়জনিংয়ের মতো জটিল সমস্যা হতে পারে।
এসব রোগ বালাই থেকে রক্ষাসহ পুষ্টির চাহিদা জোগানে দুধের উৎপাদন বাড়াতে গাভীর ওলান প্রদাহ নিরাময়ে উদ্যোগ নেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি সাইন্স বিভাগের বিজ্ঞানী ভ. রহমান। ইউএসএ ও বাংলাদেশ একাডেমি অব সাইন্স-বাস এর অর্থ সহায়তায় ৩ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়।
গত ২০২০ সালের অক্টোবরের শুরু হওয়া এই প্রকল্প ২০২৩ সালে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও শেষ হয় গত ২০২৪ সালে। প্রকল্পে ব্যয় করা হয় ৫৫ লাখ টাকা।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডক্টর বাহানুর রহমানের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন শিক্ষক অধ্যাপক ড. ফেরদৌসুর রহমান খান ও ড. জাহাঙ্গীর আলম, পিএইচডি শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান, এমএস শিক্ষার্থী লিওনোল ইসলাম লিয়ন ও একজন টেকনিশিয়ান যোগ দেন এই প্রকল্পে। প্রকল্পের আওতায় দেশের পাবনা, সিরাজগঞ্জ, গাজীপুর, ঢাকা,-চট্টগ্রাম, যশোর, সিলেট, নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ এই ৯টি জেলার ২০৯টি খামারে সার্ভে করা হয়।
এরমধ্যে ১৩১টি খামারে গাভীর ওলানে প্রদাহ পজেটিভ পাওয়া যায়। শতকরা হিসেবে প্রদাহের এই হার ৬২ শতাংশ। যা এলার্মিং বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা সরেজমিন সার্ভেকালে মাঠ পর্যায়ে ৫১৭টি গাভীর ওলান থেকে স্যাম্পল কালেকশন করে পরীক্ষা করেন। পরীক্ষায় ২৩৯টি গাভীর ওলানে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার পজিটিভ উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা শতকরা হিসেবে প্রদাহের এই হার ৪৬ শতাংশ।
পরবর্তীতে ইউএসএ এর জিন ব্যাংকে ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়ার হোল জিনোম সিকোয়েন্স করে ব্যাকটেরিয়ার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে নিরলস গবেষণায় গত ২০২৪ সালের জুন মাসে উদ্ভাবন করা হয় ক্ষতিকারক এই ব্যাকটেরিয়ার প্রতিষেধক ম্যাসটাইটিস’ ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিনের উদ্ভাবক ড. রহমান জানান, ৫ মিলির ২টি ডোজে প্রতিকার মিলবে ওলানের প্রদাহ। এ জন্য খরচ পড়বে মাত্র ২০০ টাকা। গাভীর গর্ভাবস্থায় ছয় থেকে সাত মাসের মাথায় এক ডোজ এবং পরে নয় মাসের মাথায় দিতে হবে আরেকটি ডোজ।
এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, দেশে দুধের চাহিদা রয়েছে একশ’ ৫৮ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে উৎপাদিত দুধের পরিমাণ ১৫০ লাখ মেট্রিক টন। গাভীর ওলান প্রদাহ নিয়ন্ত্রণ করা গেলে উৎপাদন বেড়ে উদ্বৃত্ত হতে পারে দুধের জোগান এমন আশা বিজ্ঞানীদের।