ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ মার্চ ২০২৫, ২৬ ফাল্গুন ১৪৩১

ঝিনাইদহের ‘গাছবাড়ি’

এক বাড়িতে দুষ্প্রাপ্য ৫শ’ প্রজাতির ১০ হাজার গাছ

সাজেদ রহমান

প্রকাশিত: ২৩:৪৯, ১০ মার্চ ২০২৫

এক বাড়িতে দুষ্প্রাপ্য ৫শ’ প্রজাতির ১০ হাজার গাছ

ঝিনাইদহের গাছবাড়িতে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ

বড় গেট দিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলে বাম পাশে একটি জলাধার। পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা জলাধারের চারপাশে দেখা মেলে নানা প্রজাতির গাছ। এর মধ্যে রয়েছে রিঠা, নাগলিঙ্গম, আতর, কর্পূর, খয়ের, উদাল, মুচকুন্দ চাপা, জুহুরি চাপা, কনকচাঁপা, রাজমুকুট, রাজঅশোক, অশোক, পলাশ। জলাধারের চারপাশে ঘোরার পর আমরা আগত কয়েকজন গেলাম পশ্চিমপাশে।

সেখানেও রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ। সঙ্গে রয়েছেন এই গাছবাড়ির মালিক আমিনুল ইসলাম। তার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আরও গাছের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম। তিনি দেখালেন, শ্বেত শিমুল, শ্বেত মনিলতা, মনিমালা, শ্বেত চন্দন, রক্ত চন্দন, টেবেবুইয়া, ম্যাগনোলিয়া, বওলা, বাবলা, আমাজন ওয়াটার লিলি, জারুল, নাগেশ্বর, কাঞ্চন, কাইজেলিয়া, রক্তরাগ, রুদ্রপলাশ, বাটারফ্লাই পিউসহ আরও অনেক গাছ। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে ঘুরে ঘুরে নাম জানা, কিন্তু চোখে আগে না দেখা গাছের সঙ্গে আমরা পরিচিত হলাম।
লক্ষ্য করলাম গাছবাড়ির গাছে রয়েছে শত শত বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তারা এই গাছবাড়িকে নিরাপদ আশ্রয় মনে করে গাছে এসে বসে।
এই বাড়ির মালিক মো. আমিনুল ইসলাম। তিনি ঢাকাতে বসবাস করেন এবং সেখানেই ব্যবসা করেন। নিজের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে এলে থাকার জন্য ও ছোট-খাটো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে তিনি ২০১৪ সালে গ্রামের বাড়িতে একটি ভবন তৈরি করেন। তিনি গ্রামে একটি কাপড়ে নক্সা তোলার কাজ ও সেলাই প্রকল্প চালু করেন। নাম দেন আক্তার বানু সেলাই কেন্দ্র। এই প্রকল্পের নাম তার মায়ের নামে করেছিলেন। এরপর তিনি নিজের এই বাড়িটাকে গাছের সংগ্রহ শালা তৈরি করে বিকল্প একটি বাগান তৈরি করার চিন্তা করেন। পুরো বাড়ির নাম দেন ‘গাছবাড়ি’।
লক্ষ্মণদিয়ার গাছবাড়ি ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপা উপজেলার উমেদপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মণদিয়া গ্রামে অবস্থিত। এই গাছবাড়িটি কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের শৈলকুপা উপজেলার চাঁদপুর নামক স্থান থেকে আনুমানিক ৪ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। এই গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তের প্রথম বাড়িটি হচ্ছে গাছবাড়ি।
ঘুরে আমাদের মনে হয়েছে লক্ষ্মণদিয়া গ্রামের একটি চির সবুজ উদ্ভিদ ও গাছের তৈরি বাড়িটি পরিবেশ রক্ষায় অনেক ভূমিকা রাখবে। আমিনুল ইসলামের এই উদ্যোগ সারা দেশে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছে ও আলোচিত হয়েছে। এটা বর্তমানে ঝিনাইদহ জেলার একটি অন্যতম পর্যটন এলাকা। এই গাছ বাড়িতে প্রায় দশ হাজার দেশী-বিদেশী গাছ রয়েছে। 
এই গাছবাড়িটি দুইতলা বিশিষ্ট। দুই তলাতেই বহু গাছ রয়েছে। দালানের দেওয়ালে জড়ানো রয়েছে গাছ, নিচতলা ও উপর তলাতে এমনভাবে গাছগুলো জড়ানো রয়েছে, দেখে মনে হবে এই বাড়ির দেওয়ালগুলোই গাছের তৈরি। তিনি বাড়িটির দেওয়াল ওয়াল কার্পেট নামক গাছ দিয়ে মুড়িয়েছেন।

গোটা বাড়ির চারপাশে ৫০০ চারা রোপণ করেন, যা পরবর্তীকালে গোটা দেওয়াল ঘিরে রেখেছে। এই দুইতলা ভবনের ছাদেও গাছ রয়েছে। সামনের বিশাল আঙিনায় মূল্যবান আর দুর্লভ গাছ রয়েছে। বাড়ির রাস্তার দুই ধার দিয়ে বহু বনজ গাছ রয়েছে। এমনকি বাড়ির সেফটি ট্যাংটিও গাছ দিয়ে সাজানো। এই বাড়িতে নান্দনিক ফুল ও ফলের গাছ রয়েছে, এসব মিলিয়ে বাড়িটি একটি বৃহৎ বাগানে পরিণত হয়েছে।
এই বৃহৎ গাছবাড়িটি ১৪ বিঘা জমির উপরে অবস্থিত। এই বাগান প্রকল্প বৃদ্ধি করার জন্য আমিনুল ইসলাম জমি কিনে এর পরিমাণ ১৪ বিঘা করেছেন। ২০২১ সালের গণনায়, এ সংগ্রহশালায় নানাপ্রজাতির প্রায় ৫ হাজার গাছ ছিল। প্রতি মাসেই গাছের সংখ্যা বেড়েছে, কেননা আমিনুল ইসলাম প্রতি সপ্তাহে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসার সময় নতুন নতুন গাছ নিয়ে আসেন। তিনি এই সংগ্রহশালায় বিরল প্রজাতির গাছ সংগ্রহের জন্য বেলজিয়াম, পর্তুগাল, মালয়েশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশেই ঘুরেছেন। আমিনুল ইসলাম জানান, বর্তমান তার গাছবাড়িতে ৫শ’ প্রজাতির ১০ হাজার গাছ রয়েছে।
গাছবাড়ির মালিক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘ছোটবেলায় দেখেছি আমার মা-বাবা ও ভাইদের বাড়ির আাঙিনায় গাছ লাগাতে। তখন থেকেই গাছের প্রতি ভালোবাসা জন্মে। গাছপালা ও বন উজাড় হয়ে যাওয়া আমাকে অনেক পীড়া দেয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বিলুপ্ত গাছের পরিচয় ও গাছ গবেষণাগার তৈরির চিন্তা মাথায় নিয়েই এমন উদ্যোগ নিয়েছি। গাছের ফুল-ফলের কারণে প্রতিদিনই বাড়িটিতে বিভিন্ন প্রজাতির শত শত পাখি আসে।

গাছের বিভিন্ন ফল পাখিই খায়। এ ছাড়া নিজ উদ্যোগে প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে পাখিগুলোকে খাবার দিই। এগুলো মনের খোরাক মেটায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যদি এসব বিলুপ্তপ্রায় গাছ নিয়ে গবেষণা করতে চায়, তবে আমার সংগ্রহশালা তাদের কাজে লাগতে পারে।’

×