
পাওয়ার চায়নার কান্ট্রি ম্যানেজার হান কুন বলেছেন, ‘আমরা এমন এক সময় তিস্তা নদীতে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে এসেছি যখন এখানকার মানুষ জমি ভিটা সম্পদ হারিয়েছে। এজন্য আমরা শুনতে এসেছি এখানকার মানুষের কথা। এ প্রকল্প ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো প্রভাব ফেলবে না, কারণ এটা একটা বাণিজ্যিক প্রকল্প। যে প্রকল্পে মানুষের উপকার হয় সেই প্রকল্পে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট গৌণ এবং এ প্রকল্প পরিবেশে জন্য ক্ষতিকারক হবে না।’
সোমবার (১০ মার্চ) বিকেলে রংপুর জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা এবং পুনরুদ্ধার এসব প্রস্তাবিত প্রকল্পের ওপর অংশীজনদের নিয়ে মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে হান কুন এই মন্তব্য করেন।
এর আগে দুপুরে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সালের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ড, পাওয়ার চায়না, নদী আন্দোলনে যুক্ত নেতৃবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, তিস্তায় ক্ষতবিক্ষত ভুক্তভোগী ছাড়াও গণমাধ্যম কর্মীবৃন্দ অংশ নেন। শুরুতে প্রকল্পের উপর ডকুমেন্টারি উপস্থাপন করেন পাওয়ার চায়নার কনসালটেন্ট প্রকৌশলী মকবুল হোসেন।পরে আলোচনায় অংশ নেন অংশীজনরা।
এসময় বক্তব্য দেন মহানগর বিএনপি আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু, জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম, সদস্য সচিব আনিছুর রহমান লাকু, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) রংপুর জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল ইসলাম, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রংপুর মহানগরের আহবায়ক ইমতিয়াজ আহম্মদ ইমতি, জেলা আহ্বায়ক ইমরান আহমেদ, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারাইন পিপল ক্লাবের শামসুর রহমান সুমন, গ্রীন ভয়েসের সোহানুর রহমান প্রমুখ।
এ সময় অংশীজনরা চীন ভারতের রশি টানাটানি বাদ দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা মহা পরিকল্পনার কাজ শুরুর দাবি জানিয়ে বলেন, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়েই এ প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করতে হবে।
ভুক্তভোগীরা বলেন, উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা অববাহিকার দুই কোটি মানুষের জীবন জীবিকা বাঁচাতে সরকারের সময়ে পরিকল্পনার কাজ শুরু করতে হবে। তারা বিচ্ছিন্নভাবে নদীর কাজ করার বিপক্ষেও মত দেন। দাবি করেন তিস্তায় ক্ষতিগ্রস্ত সবপক্ষের কাছে শুনতে হবে কথা। তিস্তায় যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান দখল করে আছে তাদের সরিয়ে দিতে হবে। দখলমুক্ত করতে হবে তিস্তা।
নদী গবেষক, সংগঠক ও অংশীজনরা আরও বলেন, রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তিস্তা প্রকল্প আটকে থাকলেও নদীপাড়ে ভাঙন ও বন্যা থেমে নেই। এই ভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হচ্ছে। বিলীন হচ্ছে হেক্টরের পর হেক্টর ফসলি জমি। খরাকালে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় ও খননের কাজ শুরুর দাবিতে মানববন্ধন করেছেন রংপুরের বাসিন্দারা।
চীনের প্রস্তাবিত ‘তিস্তা প্রকল্প’ বাস্তবায়ন হলে বদলে যাবে উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলার মানুষের ভাগ্য। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে শুষ্ক মৌসুমে পানির জন্য ভারতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। নদীর গভীরতা প্রায় ১০ মিটার বাড়বে। বন্যার পানি প্লাবিত হয়ে ভাসাবে না গ্রামগঞ্জের জনপদ। সারা বছর নৌ চলাচলের মতো পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখা যাবে। এতে আছে ১০৮ কিলোমিটার নদী খনন, নদীর দু’পাড়ে ১৭৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা, চর খনন, নদীর দুই ধারে স্যাটেলাইট শহর নির্মাণ, বালু সরিয়ে কৃষিজমি উদ্ধার ও ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রক্ষা এবং প্রতি বছরে ২০ হাজার কোটি টাকার ফসল উৎপাদন।
নৌ-বন্দর এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দুই পাড়ে থানা, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনীর জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থার প্রস্তাবও রাখা হয়েছে প্রকল্পটিতে। গত ডিসেম্বরের মধ্যেই চীনের চুক্তি ও টেন্ডার। প্রকল্প ব্যয় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকা। তিস্তার পানি চুক্তির প্রয়োজন পড়বে না। ৭ থেকে ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীটির শাখা-প্রশাখা ও উপনদীগুলো ভরাট, দখল ও তিস্তার সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পরিণতিতে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় টান পড়েছে ভূগর্ভস্থ উৎসে। নদীর পানির চাপ না থাকায় সাগরের নোনাপানি দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে পড়ে ওই অঞ্চলের মৎস্য চাষ, ফসল আবাদ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে ফেলছে।
তিস্তা নদীর ভাঙনরোধে যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পের কাজ শুরু করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, অবিলম্বে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। মহাপরিকল্পনায় তিস্তা নদীর ডান-বাম উভয় তীর ঘেঁষে ২২০ কিলোমিটার উঁচু গাইড বাঁধ, রিভার ড্রাইভ, হোটেল-মোটেল-রেস্তোরাঁ, পর্যটন কেন্দ্র, ১৫০ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র, শিল্প-কারখানা, ইপিজেড, ইকোনমিক জোন, কয়েক লাখ হেক্টর কৃষি জমি উদ্ধার, বনায়ন ইত্যাদি রয়েছে। এতে পাল্টে যাবে তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষের জীবনমান। অর্থায়নের উৎস যেখান থেকে আসুক না কেন, রংপুর অঞ্চলের মানুষের জন্য এটি একটি অপরিহার্য মহাপরিকল্পনা। জনস্বার্থে এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন জরুরি।
মতবিনিময় সভায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান জানান, মতবিনিময় সভায় অংশীজনদের বক্তব্যের ভিডিও রেকর্ড ছাড়াও সকল পরামর্শ নোট করা হচ্ছে। এর সবকিছুই পানিসম্পদ উপদেষ্টার কাছে উপস্থাপন করা হবে। তারপরই এই প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি চূড়ান্ত রূপরেখা করা হবে।
আয়োজকরা জানায়, গত ৯ ফেব্রুয়ারি পানিসম্পদ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তায় গণশুনানিতে অংশ নিয়ে তিস্তা অববাহিকার ৫ জেলার মানুষের সাথে মতবিনিময় করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই অংশ হিসেবে রোববার (৯ মার্চ) গাইবান্ধায় এবং সোমবার (১০ মার্চ) রংপুরে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। আগামী মঙ্গলবার (১১ মার্চ) লালমনিরহাট, (বুধবার (১২ মার্চ) নীলফামারী এবং বৃহস্পতিবার (১৩ মার্চ) কুড়িগ্রামে ও নীলফামারীতে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে।
রিফাত