ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০৯ মার্চ ২০২৫, ২৫ ফাল্গুন ১৪৩১

গ্রাম-বাংলার গোলাঘর এখন শুধুই স্মৃতি

সংবাদদাতা, ভাঙ্গুড়া, পাবনা

প্রকাশিত: ০১:৩৫, ৯ মার্চ ২০২৫

গ্রাম-বাংলার গোলাঘর এখন শুধুই স্মৃতি

গোলাঘর এখন শুধুই স্মৃতি

গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান এগুলো এখন চলনবিলের মানুষের শুধুই স্মৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে গেছে সেই ধানের গোলাঘর। আগের দিনে কৃষকেরা তাদের উৎপাদিত ক্ষেতের ফসল গোলাঘরে মজুত রাখতেন। বসতবাড়ির আঙ্গিনায় মাটির ওপর বাঁশ আর টিনের ছাউনি দিয়ে তৈরি করা হতো ধান, গম, খেসারি, মসুরসহ নানা ফসল রাখার এ ঘর।

ধানের গোলাগুলো বসান হতো বেশ উঁচুতে। যেন তাতে বর্ষার পানি প্রবেশ না করে। গোলায় প্রবেশের জন্য রাখা হতো একটি দরজা। দরজা বাইরে থেকে তালা মেরে রাখা হতো চোরের হাত থেকে ফসল রক্ষার জন্য। এটি দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো। আধুনিক যুগে তার জায়গা নিয়েছে বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন গুদাম ঘর। তবে চলনবিলের কিছু মানুষ বাপ-দাদার স্মৃতি হিসেবে ধরে রাখতে এখনো এই গোলাবাড়ি রেখে দিয়েছেন।
পাবনার চাটমোহর পৌর সদরের জিরো পয়েন্টে পাবনা-৩ এর সাবেক এমপি আলহাজ কে এম আনোয়ারুল ইসলামের বাড়ির উঠানের একপাশে আজও দাঁড়িয়ে আছে তিনটি গোলাঘর। প্রায় ৭০ বছর আগে তৈরি করা হয়েছিল গোলা তিনটি। এখনো মাঝে মাঝে মেরামত করা হয় গোলা তিনটি। গোলাঘর গুলো এখন অনেকটাই জরাজীর্ণ অবস্থায় জায়গা দখল করে দাঁড়িয়ে আছে।
জানা যায়, এক সময়ের গ্রামবাংলার সমৃদ্ধির প্রতীক ধানের গোলা এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কৃষিক্ষেত ও কৃষকের ঐতিহ্যবাহী ধানের গোলা আধুনিক যুগের ইট, বালু আর সিমেন্টের তৈরি গুদামের কারণে হারিয়ে গেছে। গ্রাম-গঞ্জে প্রায় কৃষকের বাড়িতে ধান মজুত রাখার জন্য বাঁশ, বেত ও কাদা দিয়ে তৈরি করা হতো গোলা। পরে গোলাঘরের গায়ে ভেতরে ও বাইরে বেশ পুরু করে লাগানো হতো মাটির আস্তর। গোলাঘরের প্রবেশ পথ রাখা হতো উঁচুতে, যাতে সহজেই চোর কোনো ফসল চুরি না করতে পারে। 
এছাড়াও অতীতে সমাজের নেতৃত্ব নির্ভর করত কার কয়টি ধানের গোলা আছে । শুধু তাই নয় কন্যা ও বর পক্ষের বাড়ির ধানের গোলার খবর নিত উভয়পক্ষের লোকজন, যা এখন শুধু কল্পকাহিনী। 
এ বিষয়ে কথা হয় পাবনার ভাঙ্গুড়া  উপজেলার কয়েক কৃষকের সঙ্গে, যাদের বাপ-দাদারা গোলাঘরে ধান রাখতেন।
তারা জানান, আগের দিনে ধান রাখার জন্য গোলাঘর ব্যবহার করা হতো। গোলাঘরে ধান রাখায় ইঁদুর ও পোকামাকড়ের উৎপাত থেকে ফসল রক্ষা পেত। একটি বড় গোলাঘরে সাধারণত ২-৩শ’ মণ পর্যন্ত ধান রাখা হতো।
খান মরিচ  ইউনিয়নের ৯০ বছর বয়সী আসাদ আলী  বলেন, ইট, পাথর, বালি, সিমেন্ট আর রডের আবিষ্কার হওয়াতে অতীতের অনেক জিনিস এখন অচল হয়ে গেছে। আমাদের সময় ভাদ্র মাসে জমিতে পানি থাকত। পানির মধ্যে আউশধান কেটে ভিজা ধান গোলায় রাখতাম। ভিজা ধান গোলায় শুকিয়ে যেতে। আবার ওই ধানের চাল অনেক শক্ত হতো।

ভাত খেতেও সুস্বাদু। এখন এসব আর হয় না, আধুনিকতার ছোঁয়ায় সব হারিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গুড়ার ৮০ বছর বয়সী আয়সা বেওয়া বলেন, আমাদের সময় প্রায় সব গার্হস্থ্য বাড়িতে গোলাঘর ছিল। সারাবছর গোলা থেকে ধান বের করে তা সিদ্ধ-শুকান করে ঢেঁকিতে ছেঁটে  চাল বের করতাম। এখন আর তা করতে হয় না। মিল-কারখানা আর চাতালে এসব কাজ হয়। সাবেক এমপি আলহাজ কে এম আনোয়ারুল  ইসলাম জানান, আমাদের এই গোলাঘরটির বয়স প্রায় ৭০ বছর।

আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, বাবা-মা এই গোলাঘর বোঝাই করে ধান রাখত। সারাবছর তিনটি গোলায় প্রায় ৬শ’ মণ ধান থাকত। এখনো প্রতিবছর গোলা মেরামত করে ধান রাখি। চলনবিলের ঐতিহ্য কালের সাক্ষী হিসেবে আজও আমরা ধানের গোলাঘর রেখে দিয়েছি।

×