
ছবি: সংগৃহীত
পাখি-সব করে রব, রাতি পোহাইল। কাননে কুসুমকলি, সকলি ফুটিল। মদনমোহন তর্কালঙ্কার'র লেখা বিখ্যাত এ কবিতার মতই ছিল চলনবিল অধ্যুষিত পাবনার চলন বিলের প্রত্যেকটি উপজেলার গ্রাম-অঞ্চলের প্রকৃতি। এক সময় এ সকল এলাকার মানুষের সকালের ঘুম ভাঙতো বিভিন্ন পাখির কিচিরমিচির ডাকে। সবুজ শ্যামল ছায়াঘেরা এই গ্রাম-বাংলায় অবাধ বিচরণ ছিল বিভিন্ন বন্য পাখিদের। তবে এখন আর গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিতে আগের মত পাখির ডাকা ডাকি শোনা যায় না।
এই পাখিগুলো মূলত বাঁশঝাড়, বন জঙ্গল বা নদীর ধারে ঘুরে বেড়াত। মাত্র দেড় যুগ আগেও চলনবিল অঞ্চলের মাঠ-ঘাটে, বাড়ির পাশের গাছ-পালা, ঝোঁপঝাড়ে শতাধিক প্রজাতির বিভিন্ন পরিচিত ও অতিথি পাখির দেখা মিলত। কিন্তু এখন আর পাখিগুলো তেমন চোখে পড়ে না।
চলনবিল অঞ্চলে দেখা পাওয়া উল্লেখযোগ্য পাখির মধ্যে রয়েছে, নীল কণ্ঠ, চোখ গেলো, জল ময়ূর, নীল রাজন, অম্বর চুটকি, কাটুয়া চিল, কমলা বউ, দেশি বাবুই, হটিটি, সাদা খঞ্জন, শাহ বুলবুলি, মোহনচূড়া, বন চড়ুই, ফটিকজল, ভরত, তিলা মুনিয়া, এশীয় বসন্ত বাউরী, কমলা বউ, চোখ গেল, কাবাসি, কসাই পাখি, ভোমরা ছোটন, মেঠো পেট পাপিয়া, সাহেলী, ডাহুক ইত্যাদি।
পাখি প্রেমীদের অভিমত, নির্বিচারে বন উজাড়, বাড়ির আশপাশে পুরোনো গাছ কেটে ফেলা, অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়ন, খাদ্য সংকট সহ বিভিন্ন কারণে আশ্রয় হারাচ্ছে পাখিরা। এছাড়া শিকারিদের কারণেও পাখির সংখ্যা দিন দিন আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে।
পাখি প্রেমীরা জানান, এখন গ্রামঞ্চলের ফসল খেতে অতিমাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। এর ফলে পাখির খাবার ছোট মাছ এবং বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় ও কীটপতঙ্গ মরে যায়। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই পাখির খাবারের স্বল্পতা দেখা দেয়। পাখিরা খাবার না পেয়ে এসব অঞ্চলে আর থাকছে না। পাশাপাশি উচ্চমাত্রার কীটনাশক ক্ষেতে ব্যবহারের ফলে পানি বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে বিষাক্ত পানি খেয়ে বছরে অসংখ্য পাখি মারা যাচ্ছে বলে জানান তারা।
ভাঙ্গুড়া উপজেলার খান মরিচ ইউনিয়নের পাখি প্রেমী আব্দুর রাজ্জাক সাহেব জানান, এক সময় এই চলনবিল অঞ্চল পাখিদের অভয়ারণ্য ছিলো। তবে এখন আর নেই। বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন থাকলেও তার যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা না থাকায় এলাকার প্রাকৃতিক অভায়ারণ্যগুলো সব ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। গ্রামের নদীগুলোতে আগে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়ি পরতো। গাছ ও বাঁশ ঝাড়ে তাদের বাসা দেখা যেত। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছ পালা কেটে ফেলায় পাখিরা অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
ভাঙ্গুরার কারিগরি কৃষি কলেজের পরিচালক রফিকুল ইসলাম রনি বলেন, চাটমোহর একটি চলনবিল বেষ্টিত অঞ্চল। এখানে ছোট ছোট অনেক পুকুর খাল, বিল, ডোবা, জলাশয় রয়েছে। সেই সঙ্গে অনেক ঝোপঝাড়, জঙ্গল, ঘাস, লতাপাতা, বট, পাকুর সহ অনেক ফলজ গাছও রয়েছে। যেগুলো পাখিদের বসবাস ও খাবারের জন্য খুবই উপযুক্ত। তবে পুকুর ও খালে ঘাস নিধনে বিষ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। বিষ প্রয়োগ বন্ধ না করা হলে পাখিরা সব মারা যাবে।
একই এলাকার বাঘলবাড়ি মাদ্রাসার কৃষি শিক্ষক রাশিদুল হাসান মানিক বলেন, আগে এলাকায় তালগাছ, নারিকেল গাছ, সুপারি গাছে বাবুইপাখির বাসা দেখা যেত। বর্তমানে তালগাছ সহ বিভিন্ন পুরাতন গাছ কেটে ফেলায় বাবুইপাখি ও তার দৃষ্টিন্দন বাসা আর দেখা যায় না। যেকোনো প্রাণীর অস্তিত্ব নির্ভর করে দুটি বিষয়ের ওপর। এর একটি নিরাপত্তা এবং অপরটি খাদ্যের নিশ্চয়তা। পাখির বেঁচে থাকা বা অস্তিত্বের জন্য এ দুটি বিষয় মুখ্য। বর্তমানে আমাদের এলাকায় পাখির অস্তিত্ব হুমকির মুখে এটা প্রাকৃতিক কারণে নয় এর জন্য বেশি দায়ী মানুষের অসচেতনতা।
এ বিষয়ে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যার অধ্যাপক ড. নাজমুল ইসলামের সাথে কথা হল তিনি জানান, ”চলনবিলে বিভিন্ন ডেভলপমেন্টের নাম করে সড়ক পথ, রেলপথ, ব্রিজ, কালভার্ট করে খন্ড খন্ড করে ফেলেছে। যে কারণে চলনবিলের যে প্রবাহমান জলাধার ছিল সে জলাধার দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এবং সেটি এখন এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে প্রায় এক হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে সেটা এখন প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ বর্গ কিলোমিটারে নেমে এসেছে। এখন সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি, ফলজ গাছ ধরে রাখা সহ পাখি সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করা হলে পরিবেশে পাখি টিকিয়ে রাখা সম্ভব”।
পাবনা জেলা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী তারিকুর রহমান বলেন, ”পাখি টিকিয়ে রাখতে দুইটি বিষয় জরুরি একটি আবাসন আরেকটি খাদ্য। পাবনায় প্রাকৃতিক বনায়ন নেই, আছে শুধু সামাজিক বনায়ন। পাখির আশ্রয়স্থল নিশ্চিতে সড়কের ধারে বা বিভিন্ন জায়গায় গাছ রোপণ ও বাগান তৈরি করে পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি গাছ রোপণে উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে গাছপালা কেটে স্থাপনা নির্মাণ ও গাছকে রক্ষা করে কিভাবে উন্নয়ন সম্ভব, সে বিষয়ে মানুষের মাঝে বিভিন্ন সচেতনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছি।
মায়মুনা