ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৭ মার্চ ২০২৫, ২৩ ফাল্গুন ১৪৩১

নওগাঁ

শিক্ষক পরিচয়ে সাড়ে ৫ লাখ টাকা আদায়, ফেরত চাইতে গিয়ে বিপাকে নারী

নওগাঁ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০৫:১১, ৭ মার্চ ২০২৫; আপডেট: ০৫:১৭, ৭ মার্চ ২০২৫

শিক্ষক পরিচয়ে সাড়ে ৫ লাখ টাকা আদায়, ফেরত চাইতে গিয়ে বিপাকে নারী

ছবি : জনকণ্ঠ

নওগাঁয় লক্ষী রানী শীল (৫৫) নামে এক নারীর থেকে ৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা ঋণ নেয়ার পর প্রায় ৮ বছরেও ফেরত না দেয়ার অভিযোগ উঠেছে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। অভিযোগ উঠা ওই শিক্ষকের নাম নগেন্দ্রনাথ দেবনাথ (৪০)। তিনি শহরের চকপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক (ইংরেজি) পদে কর্মরত রয়েছেন।

ভুক্তভোগী ওই নারীর অভিযোগ, ৮ বছর আগে তার ছেলে-মেয়েকে প্রাইভেট পড়াতে আসতেন নগেন্দ্রনাথ। ওইসময়ে চাকুরীতে টাকার বিশেষ প্রয়োজনের কথা বলে দুই দফায় ৫ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০ টাকা আমানত নেন তিনি। নগেন্দ্রনাথের নিজস্ব একটি সমবায় সমিতি ছিলো। ওই সমিতির মাধ্যমে আমানতের এই টাকার কিছু লভ্যাংশ দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সে। তবে টাকা হাতে পাওয়ার এক মাস না পেরোতেই সে নানান  তালবাহানা শুরু করে। এক পর্যায়ে সে হঠাৎই নওগাঁ থেকে উধাও হয়ে যায়। প্রায় দেড় বছর পর নওগাঁয় ফিরে আসে সে। এরপরেও সে টাকা ফেরত না দেয়ায় নিরুপায় হয়ে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের পরামর্শে থানায় অভিযোগ করেন তিনি।

লক্ষী রানী শীল বলেন, বৃদ্ধ বয়সের শেষ সম্বল ছিলো ওই টাকা। স্বামী এখন চলাচলে অক্ষম। এই টাকা ফেরত না পেলে আত্মহত্যা করা ছাড়া উপায় থাকবে না। অভাব অনটনের কারণে আরেকটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়েছে। শিক্ষক পরিচয়ে নগেন্দ্রনাথ আমার সাথে প্রতারণা করেছেন। টাকা ফেরত চাওয়ায় সাংবাদিক এবং সন্ত্রাসী পরিচয়ে বিভিন্নজনকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে হুমকি ধামকি দিচ্ছে।

শহরের হাট নওগাঁ মহল্লার বাসিন্দা লক্ষী রানীর প্রতিবেশী মোহাম্মদ রানা বলেন, দীর্ঘ ১২ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই এলাকায় ভাড়া থেকে নিজের ছেলে মেয়েকে পড়ালেখা করিয়েছেন লক্ষী দিদি। তার স্বামী এখন পঙ্গুত্ব অবস্থায় পড়ে আছেন। এমন একটি অসহায় নিরীহ মহিলার থেকে পুরোপুরি প্রতারণার মাধ্যমে টাকা নিয়েছেন নগেন্দ্রনাথ। এখন টাকা ফেরত দেয়া তো দূরের কথা উল্টো সাংবাদিক পাঠিয়ে হুমকি দিয়ে লক্ষী দিদির থেকে চাঁদা আদায় করাচ্ছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক নগেন্দ্রনাথ দেবনাথ বলেন, ২০১৭ সালে লক্ষী দিদির থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা নিয়েছিলাম। শর্ত অনুযায়ী অনেক টাকা লভ্যাংশ দিয়েছি। পরে ঋণগ্রস্ত হয়ে নওগাঁ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। যেহেতু অনেক টাকা লভ্যাংশ দিয়েছি, তাই বাকী টাকা দেয়া সম্ভব নয়। লক্ষী দিদির অভিযোগগুলো সঠিক নয়।

এদিকে বৃহস্পতিবার (০৬ মার্চ) সরেজমিন চকপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ে গেলে শিক্ষক নগেন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। জানা যায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো নগেন্দ্রনাথের। সেই সুবাদে পাওনাদারদের তোপের মুখে টানা দেড় বছর স্কুল ছেড়ে পালিয়ে থাকার পর ফেরত আসলেও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটি। উল্টো নগেন্দ্রনাথকে পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচাতে বিদ্যালয়ের ভবনে থাকার জায়গা করে দেয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ নিয়ম-নীতি বহির্ভূত। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর শিক্ষক শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বিদ্যালয়ের মূল ভবন ছাড়লেও পরিত্যক্ত ভবনে নতুন করে নিজের বাসস্থান তৈরি করে নেয় নগেন্দ্রনাথ। তার পাওনাদাররা প্রায়ই বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে টাকা ফেরত পেতে ধর্ণা দেন। 

চকপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সাদনান সাকিব বলেন, নগেন্দ্রনাথ স্যার আইপিএলে অনলাইন জুয়া খেলতেন। জুয়ার  নেশায় তিনি বিভিন্ন জনের কাছে থেকে প্রতারণার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর জুয়াতে বাজি রেখে হেরে যান। মূলত এই কারণেই ঋণগ্রস্ত হয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পালাতে হয়েছিল তাকে। 

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে চকপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেলাল উদ্দিন  বলেন, পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের ২ দিন আগে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। এরপর থেকেই নগেন্দ্রনাথের বিভিন্ন পাওনাদার আমার কাছে এসেছে। তার পাওনাদারদের তালিকা অনুযায়ী আমার কাছে থাকা যে তথ্য আছে নগেন্দ্রনাথের থেকে কমপক্ষে ১৮ লক্ষ টাকা বিভিন্ন জন পাবেন। এছাড়াও রূপালী ব্যাংক থেকে মোটা অংকের টাকা লোন নিয়ে রেখেছে সে। ব্যাংক থেকে বেশ কয়েকবার নোটিশ করা হয়েছে নগেন্দ্রনাথকে। এখন নগেন্দ্রনাথ যে বেতন পায় তার বেশিরভাগই ব্যাংক কেটে নেয়। গত সরকারের আমলে তৎকালীন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় নগেন্দ্রনাথ এর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। আমি যোগদানের পর নগেন্দ্রনাথকে মূল ভবন থেকে বের করে দিয়েছি।
 

রিজভী আহমেদ রিজোয়ান/মো. মহিউদ্দিন

×