
দীর্ঘ ১২ বছরেও নারায়ণগঞ্জের বহুল আলোচিত মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার তদন্ত শেষ করতে পারেনি তদন্তকারী সংস্থা র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন টিম( র্যাব)। পাঁচ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর তদন্তকারী সংস্থা র্যাব নড়েচড়ে তৎপর হয়ে উঠে। কিন্তু কয়েক মাস যেতেই আবার যেন ধীরগতি চেপে বসেছে তদন্তে। দীর্ঘদিনেও বিচার না পাওয়া হতাশ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ত্বকীর পরিবার ও সাধারণ মানুষ।
২০১৩ সালের ৬ মার্চ বিকেলে নারায়ণগঞ্জ শহরের কালীরবাজারের বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয় মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী । এর দুই দিন পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যা নদী কুমুদিনী খাল থেকে তক্বীর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ লেভেল পরীক্ষায় রসায়ন ও পদার্থ বিদ্যায় বিশ্বের সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়া এ মেধাবী ছাত্র ত্বকী।
ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বির অভিযোগ তৎকালীন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানে নির্দেশে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী অপহৃরনের পর তুলে নিয়ে আজমেরী ওসমানের টচারসেলে নিয়ে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে ত্বকীকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কয়েকজন আসামিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেপ্তার করে। তাদের মধ্যে দুজন ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি প্রদান করে। কারা কি ভাবে ত্বকীকে খুনি করেছে। আসামি শওকত সুলতান ভ্রমরের আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে র্যাব বহু আলামত উদ্ধার করে। জবানবন্দিতে ১১ জন ত্বকী হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়ার কথা জানায়। হত্যাকাণ্ডে ওসমান পরিবার জড়িত থাকায় তাদের রক্ষা করতে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মামলার তদন্ত কাজ স্তিমিত হয়ে যায়।
রফিউর রাব্বি বলেন, দীর্ঘ ১২ বছরের মধ্যে সাড়ে ১১ বছর ছিলো ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসন। অর্ন্তবর্থী সরকার এই হত্যার বিচার করতে চায়। তবে সেই বিচার সম্পন্ন করতে হলে প্রয়োজন একটি নির্ভুল অভিযোগপত্র। নির্দেশদাতা শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান , শাহ নিজামসহ যারা এই হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত তাদের সবাইকে অভিযোগপত্রে যুক্ত করার দাবি করেন তিনি। নতুন গ্রেপ্তারকৃত ছয়জনসহ হুকুমদাতা শামীম ওমসান ও শাহ নিজামকে এই অভিযোগপত্রে যুক্ত করতে হবে। কারণ আমরা জেনেছি,. ত্বকীকে অপহরণের পর সায়াম প্লাজায় শাহ নিজামের অফিসে নেয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় আজমেরী ওসমানের টর্চার সেলে।
‘ত্বকী নেই’ এটি চিরন্তন সত্য হলেও কি হবে? মা রওনক রেহানা কাছে ত্বকী যেন এখনো জীবন্ত। তাই তো দীর্ঘ ১২ বছর ধরে ত্বকীর শোবার ঘরটি পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। খাতার ফাঁকে ফাঁকে ত্বকীর লেখা কবিতা পড়ে পুত্রকে বলা হয়নি, এমন একটা কিছু বলার অপেক্ষায় থাকেন তিনি। ত্বকীর সাথে তার কথা না হওয়ার সময়টা আজ এক যুগ অতিবাহিত হলো। পুত্র হত্যার বিচারের দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার হতাশ হয়ে তিনি বলেন, এ সরকারের সময়টাতে ত্বকী হত্যার বিচারকার্য শেষ হবে এমনটাই আশা করেন তিনি।
নারায়ণগঞ্জের সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা ত্বকী হত্যাকাণ্ডের চার্জশিট ও বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজনের নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার সভাপতি ধামান সাহা জুয়েল এবং নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি ভবানী শংকর রায় জানান, ত্বকীর হত্যাকারী তৎকালীন সরকারের অংশ হিসাবে থাকার বিচার হবেনা বলে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে মোমশিক্ষা প্রজ্জলনসহ নানা কর্মসূচি করে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন । জুলাই বিপ্লবের পর র্যাব তৎপর হয়ে আবার ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। কিন্তু দীর্ঘদিনে চার্জশিট প্রদান না করায় হতাশ প্রকাশ করেছেন তারা । তবে তারা দাবি করেন, আমলা এখন আশাবাদী এই অর্ন্তবতীকালিন সরকার এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করবে। যারা এতোদিন এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে দেয়নি তাদেরও বিচার করবে বর্তমান সরকার।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন ঢাকা বিভাগের সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাছুম বলেন, দীর্ঘ ১২ বছর ধরে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ছেলে হত্যার বিচার পাচ্ছেনা একটি পরিবার। এরচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কি হাতে পারে। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক ছিল শামীম ওসমান । তার ছেলে অয়ন ওসসমান ও ভাতিজা আজমেরী ওসমানকে দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
পতিত স্বৈরাচারের প্রধানমন্ত্রী শামীম ওসমান যেন বিচারের সম্মুখীন না হয় সে জন্য মামলার তদন্ত কাজ বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি দ্রুত তদন্ত শেষ করে র্যাবেকে চার্জশিট আদালতে দাখিল করার দাবি জানান।
ত্বকী হত্যা মামলার ৮১ তম ধার্য তারিখ গেলেও আদালতে এখনো অভিযোগ পত্র দাখিল হয়নি। এ সরকারের সময়ে দ্রুত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবীর অ্যাডভোকেট প্রদীপ ঘোষ বাবু দাবি করেন।
আর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবুল কালাম আজাদ বলেন, শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ওসমান পরিবারের পাশে থাকবেন এমন বক্তব্যের পর মামলার তদন্তের কাজ ঠিকমতো পরিচালনা করেনি। বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালিন সরকার দায়িত্ব নেবার পর স্বাধীনভাবে এই মামলার তদন্ত কাজ এগিয়ে যাচ্ছে । বাদি ন্যায় বিচার পারে বলে আশা করছেন সরকারের এই আইন কর্মকতা ।
মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব ১১ সিও লে. কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, ত্বকী হত্যাকাণ্ডের তদন্ত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে আমরা এই মামলায় আরো ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছি। তাদেরকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আরো যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তা নিয়ে আমাদের তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত শেষ হওয়া মাত্রই অভিযোগ পত্র আদালতে দাখিল করা হবে।
২০১৩ সালের ৮ মার্চ নিহতের পিতা রফিউর রাব্বি বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলা তদন্তের দায়িত্ব গ্রহণ করে র্যাব -১১। ২০১৪ সালে ৮ মার্চ তৎকালীন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটিত হয়েছে উল্লেখ করে ১১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ পত্রের খসড়া গণমাধ্যমে প্রকাশ করে শীঘ্রই তা দাখিলের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এখনো অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়নি।
সাজিদ