
রাজধানীর শাহজাদপুরে সোমবার একটি হোটেলে আগুন লাগে
রাজধানীর শাহজাদপুরে একটি ছয়তলা ভবনে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। ছয়তলা ভবনটির দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লারে আগুনের সূত্রপাত ঘটে। পরে আগুন ও ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনে। তৃতীয় তলা থেকে ৬ষ্ঠ তলা পর্যন্ত হোটেলের অতিথিদের অনেকে দৌড়ে নিচে নামতে সক্ষম হলেও চারজন নামতে পারেননি। তারা ছাদে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ছাদে থাকা চিলেকোঠার দরজাটি বন্ধ ছিল।
ফলে অতিরিক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে সেখানেই মারা যান তারা। এদের মধ্যে একজনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। মৃত প্রত্যেকের মরদেহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছে পুলিশ। তবে অগ্নিকা-ের পর থেকেই হোটেল কর্তৃপক্ষ পলাতক রয়েছে। ভবনটিতে ছয়-সাত মাস আগে একবার আগুন লেগেছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে এবারের ঘটনাটি নাশকতা কিনা, তা খতিয়ে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা।
প্রত্যক্ষদর্শী ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় তলার বিউটি পার্লার থেকে। পরে বিউটি পার্লার থেকে আগুন বাড়তে থাকে আর প্রচ- ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, নিচ তলায় তিনটি দোকান রয়েছে, দ্বিতীয় তলায় মেয়েদের একটি বিউটি পার্লার ও তিনতলা থেকে ছয় তলা পর্যন্ত সৌদিয়া হোটেল। তবে ভবনটির ছয় তলার অর্ধেক হোটেল রুম আর বাকি অর্ধেক ছাদ। শুধুমাত্র তৃতীয় তলায় বিউটি পার্লার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভবনের নিচতলা আংশিকভাবে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভবনের নিচ তলায় আছে রুমা ডিজিটাল নামে একটি স্টুডিও। এ ছাড়া রয়েছে মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচার ও মুন্নি এন্টারপ্রাইজ নামে দুটি দোকান এবং দ্বিতীয় তলার পার্লারটির নাম গোল্ডেন টিউলিপ। ভবনের ভেতরে বিভিন্ন ফ্লোরে কাঁচের ভাঙা টুকরো দেখা যায়।
নিচ তলার মা ডোর সেন্টার অ্যান্ড ফার্নিচারের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, আগুন লাগে বেলা ১২টা ১৫ মিনিটের দিকে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে দোকানের ক্যাশ বক্স নিয়ে বের হয়ে যাই। আল্লাহর রহমতে আমার দোকানে তেমন ক্ষতি হয়নি। তবে জানতে পেরেছি, দুই তলার বিউটি পার্লার থেকে আগুনটা সৃষ্টি হয়।
সেখানে নাকি এসি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। এরপর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নেভান। কিন্তু আগুনে প্রচ- ধোঁয়ার সৃষ্টি হয়, যা ওপরের দিকে চলে যায়। তবে অগ্নিকা-ের সময় পার্লারটি বন্ধ ছিল বলে জানা গেছে।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার পর ফায়ার সার্ভিস ভবনটির চিলেকোঠা থেকে তিনজনের মরদেহ এবং চতুর্থ তলার টয়লেট থেকে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে। এদের কারও শরীর পোড়েনি। ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষও বলেছে, আগুনে পুড়ে নয়; ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাংবাদিকদের ফায়ার সার্ভিস ঢাকা জোনের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, ভবনটিতে আগুন লাগার পর হোটেলে থাকা চারজন ভয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছাদে থাকা চিলেকোঠার দরজাটি বন্ধ ছিল। ফলে অতিরিক্ত ধোঁয়ায় তারা মারা যান। তিনি বলেন, আগুন লাগার ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা ঘটনাস্থলে পৌঁছাই। একটার পরপর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনি।
এখানে নিচতলায় হার্ডওয়্যারের দোকান, দ্বিতীয় তলায় বিউটি পার্লার, তৃতীয় তলা থেকে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবন। দুই তলায় প্রচ- আগুন ও ধোঁয়া ছিল। ঘটনাস্থলে মোট চারটি ইউনিট কাজ করে। প্রায় ৩০ মিনিটের মধ্যে আমরা আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হই। ভবনটির চিলেকোঠায় তিনজনের মরদেহ এবং একজনকে শৌচাগার থেকে উদ্ধার করা হয় জানিয়ে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ছাদে যাওয়ার জন্য চিলেকোঠার দরজা বন্ধ ছিল। ধোঁয়ার কারণে আবাসিক হোটেলের ভেতরে যারা ছিলেন, তারা বাঁচার জন্য ওপরের দিকে উঠে যান।
ওপরে উঠতে গিয়ে তারা দেখতে পান ছাদের দরজা বন্ধ। এরপর তারা আর সেখান থেকে বের হতে পারেননি। তাই মনে হচ্ছে ধোঁয়ার কারণেই চারজনের মৃত্যু হয়েছে। অগ্নিকা-ের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগুনের কারণ এখনই বলা যাচ্ছে না। মালিক বা কর্তৃপক্ষের কাউকে আমরা পাইনি। কমিটি গঠনের পর তদন্ত করে আগুনের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা হবে।
ভবনটি নিয়ম মেনে তৈরি করা হয়েছে কি না এবং পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল কি না জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বলেন, রাজউকের নিয়ম অনুযায়ী বিল্ডিংটি তৈরি করা হয়নি। ভবনটিতে কোনো ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিল না এবং অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না। সিঁড়িগুলো ছিল সরু। সিঁড়ির পাশে যে জানালা ছিল সেগুলো কাঁচ দিয়ে বন্ধ করা। কাঁচ দিয়ে বন্ধ করা না থাকলে ধোঁয়া বের হয়ে আসতে পারত।
ছেলেকে বিদায় জানাতে এসে চিরবিদায় নিলেন বাবা ॥ মৃত চারজনের মধ্যে একজনের পরিচয় জানা গেছে। তার নাম মিরন জমাদ্দার (৬০)। বাড়ি পিরোজপুরে। তিনি সোমবার সকাল আটটার দিকে হোটেলটিতে ওঠেন। তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিরনের ছেলে মুবিন জমাদ্দারের মঙ্গলবার (আজ) সন্ধ্যায় একটি ফ্লাইটে সৌদি আরবে যাওয়ার কথা। মিরন সকালে বোনজামাই হিরন তালুকদারের সঙ্গে পিরোজপুর থেকে ঢাকায় আসেন।
ঢাকায় এসে তিনি সকাল আটটায় হোটেলটিতে ওঠেন। হোটেলে ওঠার পর তিনি আবার বাইরে বের হন, নাস্তা করেন একটি দোকানে। নাস্তা শেষে হোটেলে যান বিশ্রাম নিতে। এরই মধ্যে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। আগুন লাগার পর কোথাও বের হতে না পেরে জীবন বাঁচানোর জন্য ফোন দেন হিরনকে। হিরনকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মিরন বলেন, আমি বাঁচার কোনো পথ পাচ্ছি না। চারদিকে ধোঁয়া, দম বন্ধ হয়ে আসছে। এই কথা বলার পরে ফোন কেটে যায় মিরনের। ফায়ার সার্ভিস আগুন নিয়ন্ত্রণের পর মিরনের মরদেহ চারতলা থেকে উদ্ধার করে।
হিরন তালুকদার বলেন, আমরা সকালে এসে হোটেলটির ৪০২ নম্বর রুমে উঠি। মিরন হোটেলের পাশে একটি রেস্টুরেন্ট থেকে নাস্তা করে ফের হোটেলে যান এবং আমাকে বলেন, আপনি নাস্তা করে আসেন, আমি একটু বিশ্রাম নেই। এর কিছুক্ষণ পরে আগুন দেখে হোটেলের নিচে দৌড়ে আসি। এসে দেখি পুরো হোটেল আগুনে ধোঁয়াচ্ছন্ন। তখনই মিরন আমাকে ফোন দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, চারদিকে ধোঁয়া, কোথাও যাওয়ার জায়গা পাচ্ছি না। তিনি হোটেলের চারতলার রুমে ছিলেন।
মিরন জমাদ্দারের ছেলে মুনিম জমাদ্দার বলেন, দুই বছর আগে রোজার মধ্যে আমার মা (মুন্নি বেগম) মারা গেছেন। আজ আমার বাবা মারা গেলেন। আমার আর কেউ রইল না। কার জন্য আর বিদেশ যাব। আমার আট বছরের বোনটাও আমার মত এতিম হয়ে গেল। বাড়িতে গিয়ে ওকে কী বলব! মুনিম আরও বলেন, বাবাও সৌদি থাকতেন। আট বছর আগে দেশে আসেন। দুদিন আগে আমি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলাম।
রামপুরা বউবাজার এলাকায় চাচাত ভাইয়ের বাসায় উঠেছিলাম। মঙ্গলবার (আজ) আমার ফ্লাইট। আমাকে বিদায় জানাতে আমার বাবা আর মামা সকালে এসেছিলেন। সকালে শাহজাদপুর ওই হোটেলে ওঠার পর আমাকে ফোনে জানান। আমি দেখা করতে গিয়েছিলাম। হোটেলটিতে ঢোকার সময় আগুন দেখতে পাই। তখন আর ঢুকতে পারিনি। ফোন দেই বাবাকে, রিসিভ করে বলেন, আগুনের প্রচ- ধোঁয়ায় আটকে পড়েছেন। তখন বাবাকে চার তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে যেতে বলি।
পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের ধারণা, চারতলার বাথরুমে যে মরদেহটি পাওয়া যায়, সেই ব্যক্তি হয়তো জীবন বাঁচাতে বাথরুমের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তবে বাথরুমের ভেতরে আগুনে সৃষ্ট ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। আর বাকি তিনজন জীবন বাঁচাতে ছাদে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ছাদ বন্ধ থাকায় তারা আর যেতে পারেনি। সেখানেই ধোঁয়ার কারণে দম বন্ধ হয়ে মারা যান।
গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোখলেছুর রহমান বলেন, ভবনটির চারতলা থেকে একজনের এবং ছয় তলার ছাদের গেটের সামনে থেকে তিনজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। মরদেহগুলো আগুনের তাপে কিছুটা পুড়ে গেছে, তবে বাকি শরীর ঠিকঠাক রয়েছে। প্রাথমিক ধারণা, এ চারজন আগুনের সৃষ্ট ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে। আমরা এখন পর্যন্ত একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে পেরেছি। বাকি তিনজনের পরিচয় জানা যায়নি।
দ্বিতীয় তলার পার্লার থেকে আগুনের সূত্রপাত হলেও ঘটনার সময় সেটি বন্ধ ছিল। জানা গেছে, পার্লারটির মালিক জহিরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। তিনি দেশের বাইরে থাকেন। তার ছোট ভাই তানভীরের স্ত্রী আরেক মহিলার সঙ্গে শেয়ারে পার্লারটি চালাতেন। তবে ঘটনাস্থলে তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি।
সরেজমিনে দেখা যায়, আগুনে দ্বিতীয় তলার পার্লার কক্ষটি বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ওই কক্ষে স্পা করার তিনটি বেড, বডি ওয়াশের মেশিন, ফ্রিজসহ বিভিন্ন সাজ প্রসাধনী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, ওই কক্ষে থেকে এসি বিস্ফোরণে আগুনের সূত্রপাত। যদিও ফায়ার সার্ভিস তাৎক্ষণাৎ বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেনি। আরও দেখা যায়, তৃতীয় তলার হোটেলের রিসিপশন অংশ আগুনে পুড়ে গেছে। এছাড়া ওপরে হোটেল রুমগুলো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে।
তৃতীয় তলা থেকে ৬ষ্ঠ তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে চারটি করে হোটেল কক্ষ রয়েছে। ছাদের অংশে হোটেলের স্টাফদের থাকার জন্য ছোট কক্ষ রয়েছে। তবে আগুন লাগার পরপরই হোটেল থেকে সটকে পড়েন কর্তৃপক্ষের সবাই। সেখানে খোঁজ করেও কোনো স্টাফের সন্ধান মেলেনি।
আশপাশের ভবনের বাসিন্দাদের মধ্যে আগুন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তারা কেউ নিচে নেমে আসেন, কেউ কেউ ছাদে গিয়ে আশ্রয় নেন। উৎসুক জনতার ভিড় জমে ভবনটির সামনে। ফলে ওই এলাকা ও আশপাশের সড়কে যানজটের সৃষ্টি হয়। তবে স্থানীয়দের অনেকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের আগুন নেভাতে সহায়তা করেন।
বিকেলের দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান ডিএমপির ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্সের অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম। পরে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা ভবনটি পরিদর্শন করেছি। ধারণা করা হচ্ছে, দ্বিতীয় তলার পার্লার থেকে আগুনের সূত্রপাত। এটি নিছক দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা, তা খতিয়ে দেখা হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে এসে বিউটি পার্লার এবং হোটেলের কাউকে পাইনি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও এই দুই প্রতিষ্ঠানের কোনো কর্তৃপক্ষ বা কর্মচারীকে পাওয়া যায়নি। তাদের সন্ধান চলছে। অগ্নিকা-ের বিষয়ে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হবে।
আগেও আগুন লেগেছিল ভবনটিতে ॥ প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটিতে ছয়-সাত মাস আগে একবার আগুন লেগেছিল। তখন কোনো প্রাণহানি না ঘটলেও আগুনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ভবনটিতে।