
ছবিঃ নিহত কবির হোসেন
সোনারগাঁয়ের শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চর কিশোরগঞ্জ গ্রামের কবির হোসেন (৪৮) ভাগ্য ফেরাতে প্রবাসে গিয়ে লাশ হয়ে ফিরলেন।
সোমবার সকালে তার লাশ চর কিশোরগঞ্জ নিজ বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। লাশ আনার পর তার বাড়িতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সেখানে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীদের কান্নায় সেখানকার বাতাস ভারী হয়ে উঠে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায় যে, ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে পরিচিত এক দালালের মাধ্যমে তিনি ঢাকার পুরনো পল্টনের বিকে ইন্টারন্যাশনাল লির্বাটি ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিডেট নামের একটি এজেন্সির মাধ্যমে ২০২৪ সালের ১৩ মে তিনি উজবেকিস্তান যান।
সেখানে তাকে আটকে রেখে মুক্তিপনের জন্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। অনাহার ও নির্যাতনে তিনি ১৩ জানুয়ারী মারা যান। পরিবার মুক্তিপনের ৮০ হাজার টাকা দিয়েও বাচাঁতে পারেননি কবির হোসেনকে। টাকা পাঠাতে দেরি হওয়ায় তার ওপর নির্যাতন বেড়ে যায়।
কবির হোসেনের ভাগ্য তো ফিরলো না, লাশ হয়ে ফিরলেন নিজ বাড়িতে। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম বাদী হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি বিকেলে সোনারগাঁ থানায় দু’জনকে আসামী করে অভিযোগ দায়ের করেন। বাদী জানান, অভিযোগের পর পুলিশ তদন্ত তো দূরের কথা, ফোনেও তাদের সঙ্গে কথা বলেননি। সোমবার সকালে শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চর কিশোরগঞ্জ এলাকায় তার বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা হয়। সেখানে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতরণা হয়।
নিহতের বড় ভাই এবাদুল্লাহ জানান, উপজেলার শম্ভুপুরা ইউনিয়নের চর কিশোরগঞ্জ গ্রামের মো. আবুল কাশেমের ছেলে কবির হোসেনসহ তারা ৫ ভাই। ভাইদের মধ্যে কবির হোসেন আর্থিকভাবে দূর্বল ছিল। বাড়িতে থাকাবস্থায় সে রাস্তার পাশে পিঠা বিক্রি, অল্প পুঁজিতে মুদি ব্যবসা, কখনো অটোরিক্সা চালাতেন। বিভিন্ন এনজিও অথবা নির্দিষ্ট সুদের বিনিময়ে গ্রামীণ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের চাপে তিনি বিদেশ যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পরে আত্মীয় স্বজন ও এনজিও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ ও কর্জ নিয়ে গত বছরের ১৩ মে একটি বিমান ফ্লাইটে উজবেকিস্তান যান। সেখান থেকে তার তুরস্ক যাওয়ার কথা ছিল।
তিনি আরও জানান, তুরস্ক নেওয়ার কথা বলে সেখানে একটি কক্ষে নিয়ে মুক্তিপনের জন্য আটকে রেখে নির্যাতন করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাতে আকুতি জানায়। আর্থিক দূরবস্তার পরিবার টাকা যোগাতে হিমশিম খাচ্ছিল। এক পর্যায়ে একটি বেসরকারি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা গত ১২জানুয়ারি রাসেল নামের একজনের মাধ্যমে সেখানে পাঠায়। টাকা পাঠানোর পরদিন কবির হোসেনের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর লাশ আনতে গড়িমসি শুরু করে।
বিষয়টি নিয়ে সোনারগাঁ থানায় অভিযোগ দায়েরের পর আদম ব্যবসায়ী মো. জাহিদ মিয়া বিদেশ যাওয়ার ৮ লাখ টাকাসহ লাশ আনতে রাজি হন। দীর্ঘ ৪৮ দিন পর গতকাল সোমবার সকাল সাড়ে ৫ টার একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে লাশ আসে। সেখানে তিনি লাশ গ্রহন করেন। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তার বাড়িতে লাশ নিয়ে আসলে সেখানে এক হৃদয়বিদারক ঘটনার অবতরণা হয়।
জানা যায়,বাদ যোহর চর কিশোরগঞ্জ মদিনাতুল উলূম মাদ্রাসা ও এতিমখানা মাঠে জানাযা শেষে পঞ্চায়েত কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
উজবেকিস্তান কবির হোসেনের মৃত্যুর পর থেকে বিকে ইন্টারন্যাশনাল লির্বাটি ট্রেডিং কর্পোরেশন লিমিডেট নামের এজেন্সির মালিক মো. কালাম মান্নানসহ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাদের অফিসে তালা ঝুলিয়ে আত্মগোপনে যায়। সেখানে নিহতের পরিবার একাধিকবার গেলে তাদের অফিস বন্ধ পান। তাদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন করা হলে তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
নিহতের ফুফাতো ভাই রফিকুল ইসলাম বলেন, কবির হোসেনের দুই ছেলে, তিন মেয়ে। আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে ভাগ্য ফিরাতে বিদেশ গিয়েছে। কে জানতে তার এ পরিণতি হবে। তার দু’ চালা ঘরের দরজা পর্যন্ত নাই। পুরানো কাপড় ঘরের দরজা হিসাবে ব্যবহার করে। কবির হোসেনের মৃত্যুতে তার পরিবার অথৈ সাগরে হাবু ডুবু খাচ্ছে।
নিহতের স্ত্রী কহিনুর বেগম জানান, তুরস্ক যাওয়ার জন্য ৮ লাখ টাকা জমা দিয়ে উজবেকিস্তান নেওয়ার পর তাকে একটি কক্ষে নিয়ে টাকার জন্য প্রতিদিন মারধর করা হয়। প্রতিদিন মোবাইল ফোনে আমাদের কাছে কান্না করতো, দ্রুত টাকা পাঠিয়ে তাকে তাদের কাছ থেকে মুক্ত করতে। তাকে তেমন খাবার দিতো না। বরফের পানি খেয়ে ও তাদের নির্যাতনে সে মারা যান। বলতে বলতে তিনি এক পর্যায়ে মুর্ছা যান। খানিক পর আবার তিনি বলেন, একটি এনজিও থেকে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে সেই রাসেল নামের একজনের মাধ্যমে টাকা পাঠিয়েছি। রাসেলও সেই টাকা নির্যাতনকারীদের দেয়নি। আমাদেরও ফেরত দেয়নি। আমার ৫ সন্তান নিয়ে এখন সাগরে পরে আছি। আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।
সোনারগাঁ থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সঞ্জয় কুমার বসাককে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ক্ষুদে বার্তা দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
সোনারগাঁ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রাশেদুল হাসান খাঁন সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগের বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে তিনি কোর্টে মামলা করার পরামর্শ দেন। কি কারনে এসআই যাননি এ বিষয়ে খোজ নেওয়া হচ্ছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার( খ- অঞ্চল) আসিফ ইমাম বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ খবর নিয়ে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ইমরান