
নওগাঁর মান্দা উপজেলার মশিদপুরে বইমেলার স্টলে পছন্দের বই দেখছে শিশু শিক্ষার্থীরা
একেবারেই নিভৃত গ্রামের একটি স্কুল মাঠে বছরের একটি দিন ‘বইপাগল’ হয়ে থাকেন সবাই। সবাই বই কেনেন। বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। গ্রামের কৃষকরাও তাদের সন্তানদের নিয়ে বই কিনতে আসেন দল বেঁধে। বই কেনার পাশাপাশি স্কুল মাঠে একে অপরের সঙ্গে কথা বলেন, শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করেন। যেন অন্যরকম এক উৎসবের দিন।
প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ ভাষার মাসে অন্তত একদিন এমন দৃশ্য যে গ্রামে ফুটে ওঠে তার নাম মশিদপুর। মশিদপুর নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার একটি গ্রাম। গত ১৫ বছর ধরে এ গ্রামের স্কুলমাঠে একদিনের জন্য বইমেলার আয়োজন করা হয়। নিভৃত পল্লিতে বইমেলা নামের এ উৎসব হলেও দিনভর আয়োজন থাকে নানা অনুষ্ঠানের।
রাজশাহীর তানোর ও নওগাঁর মান্দা আর নিয়ামতপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী তিন উপজেলার সন্ধিস্থল চৌবাড়িয়া হাট। সেখান থেকে আরও কিছুদূর ভেতরে অপেক্ষাকৃত অনুন্নত একটি গ্রাম মশিদপুর। দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা আর শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর এ গ্রামে গত ১৫ বছর ধরে বসছে বইমেলা। সঙ্গে নানা আয়োজন। ওই গ্রাম ও আশেপাশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সহ¯্রাধিক শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা এ মেলায় অংশ নেন। শিক্ষাবৃত্তি ও অন্যান্য সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আশেপাশের গ্রামের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
গ্রামের ছায়ায় বেড়ে ওঠা একদল শিক্ষিত তরুণের উদ্যমী কার্যক্রমে এখন শিক্ষার আলোয় প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে পুরো গ্রামটি। সমাজ সংস্কারে একধাপ এগিয়ে আসা এ গ্রামটি এখন শিক্ষা-দীক্ষায় হয়ে উঠেছে প্রস্ফুটিত।
এ গ্রামের একদল যুবকের গড়ে তোলা একটি শিক্ষা সমিতির মাধ্যমে পুরো গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামে শিক্ষা বিস্তারে অবদান রেখে চলেছে। গ্রামে শিক্ষার আলো বিচ্ছুরণের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন মশিদপুর গ্রাম।
গত ১৫ বছর ধরে এ গ্রামে বছরের একটি দিন আয়োজন করা হয় বইমেলার। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গত শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দিনভর এ গ্রামে অনুষ্ঠিত হলো বইমেলার উৎসব। বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে অনন্য এ আয়োজন। বইমেলার পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তার, স্কুল থেকে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ ছাড়াও মূলত শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। সেখানে দেশের শিক্ষাবিদরাও অতিথি হিসেবে হাজির হয়ে শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান গ্রামের মানুষকে।
এবার এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সালেহ হাসান নকীব। এ ছাড়া দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদরাও আসেন এই উৎসবে। গ্রামের ভেতর দিনভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি গম্ভীরাসহ নানা আয়োজনে পুলকিত হন তারা।
মূলত ২০১০ সাল থেকে এভাবেই গ্রামের মানুষকে শিক্ষা-দীক্ষায় প্রস্ফুটিত করে তুলতে প্রয়াস চালাচ্ছে ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’। সমিতির ব্যানারে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা হয়েছে ইমাজউদ্দিন মেমোরিয়াল বৃত্তি। প্রতিবছর শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতে তুলে দেওয়া হয় শিক্ষাবৃত্তি। শুধু শিক্ষাবৃত্তিই নয়, দিনভর খাওয়া-দাওয়া আর পুরস্কার বিতরণ করা হয়। দেওয়া হয় চিকিৎসা সেবাও।
শনিবার এ উৎসবে গিয়ে দেখা যায় শিশু, কিশোর-কিশোরী আবালবৃদ্ধবনিতা ও গ্রামের কৃষকরাও জড়ো হয়েছেন স্কুল মাঠে। আশেপাশের তিন উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষ উৎসবে মেতে ওঠেন। রাজশাহী শহর থেকেও বই ব্যবসায়ীরা ওই গ্রামে গিয়ে বসান বইয়ের স্টল।
প্রতি বছরের একদিন বইয়ের সঙ্গে মানুষের নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলেই উৎসব আয়োজন করা হয় এ গ্রামে। বই পড়া, বই কেনা ও শিক্ষার প্রতি প্রজন্মকে আগ্রহী করে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে এ মেলার আয়োজন করা হয়। এবার আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হয়।
নিভৃত পল্লির কৃষি অধ্যুষিত এ গ্রামে এমন বইমেলার উদ্যোক্তাদের একজন ওই গ্রাম থেকেই উচ্চশিক্ষায় বেরিয়ে আসা মো. আব্দুর রাজ্জাক। রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক তিনি। এ বইমেলার আয়োজন নিয়ে তিনি শোনালেন নিভৃত গ্রামে বইমেলা আয়োজনের গল্প।
আব্দুর রাজ্জাক জানান, তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার মশিদপুর। সবক্ষেত্রে এ গ্রামের মানুষ ছিল অবহেলিত। এখানে অশিক্ষার হার ছিল অনেক বেশি। স্কুল থাকলেও নানা কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার প্রবণতা ছিল অনেক বেশি। এ কারণে এ গ্রামে শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তিনিই মূলত গড়ে তোলেন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি প্রতিষ্ঠান। এটির নাম ‘মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি’। এ সমিতির ব্যানারেই শিক্ষার প্রসারে নানা কার্যক্রম চলে বছরজুড়েই।
তিনি বলেন, গ্রামের মানুষের সঙ্গে বইয়ের নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন, মেধাবীদের শিক্ষার প্রসারে এগিয়ে নিয়ে আসা, স্কুলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ আর গ্রামের শিশুদের স্কুলমুখী করার লক্ষ্য নিয়ে মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতি বইমেলার আয়োজন করে আসছে। প্রথমদিকে তেমন সাড়া না পেলেও এখন এলাকায় দারুণভাবে সাড়া ফেলেছে।
শিশু-কিশোর থেকে সব বয়সী মানুষ বইমেলায় হাজির হয়ে দিনভর বইয়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তোলেন। কৃষকরাও বইমেলায় হাজির হন। বই পড়েন, বই দেখেন, কিনেও নিয়ে যান অনেকে। এজন্য শিশুতোষ থেকে শুরু করে সবধরনের বইয়ের স্টল দেওয়া হয় ওই মেলায়।
তিনি বলেন, তাদের স্বেচ্ছাসেবী এ সংগঠনের মাধ্যমে এখন সুবিধাভোগীদের সংখ্যা সহ¯্রাধিক। তার মতে, মানুষের মধ্যে বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার কারণে ওই গ্রামে পর্যায়ক্রমে এখন শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। অভিভাবকরাও তাদের শিশুদের বিদ্যালয়ে পাঠানোর ক্ষেত্রে যতœবান হচ্ছেন।
মশিদপুর শিক্ষা উন্নয়ন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা আব্দুর রাজ্জাক জানান, আগামীতে এ উৎসব আরও বড় পরিসরে আয়োজন করা হবে।