
আবদুল্লাহ আল নোমান
বর্ষীয়ান রাজনীতিক বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমান আর নেই। মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে তিনি রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। তিনি স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা এবং আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
তার মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গন এবং চট্টগ্রামে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। নোমানের ব্যক্তিগত সহকারী নুরুল আজিম হিরু জানান, ভোরে ধানম-ির বাসায় অসুস্থ হয়ে পড়লে দ্রুত তাকে স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। শারীরিক পরীক্ষা করে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুর খবর শুনে ছুটে যান বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এ সময় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন জাতীয় নেতা। শুধু চট্টগ্রাম নয়, সারা দেশের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয়। বারবার জেলে গেছেন। নির্যাতিত হয়েছেন।
তার অবদান জাতি কোনোদিন ভুলবে না। তার চলে যাওয়া রাজনীতির জন্য বিরাট শূন্যতা। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দেশের এই পরিস্থিতিতে তাকে অনেক দরকার ছিল। দেশের সংস্কারে তার অভিজ্ঞতার প্রয়োজন ছিল। এ ক্ষতি অপূরণীয়। স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমানের মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাজনীতিবিদের এখন খুব দরকার ছিল। দেশ পুনর্গঠনে তার অভিজ্ঞতাকে আমরা কাজে লাগাতে পারলাম না। তার আদর্শ থেকে আমরা শিক্ষা নেব।
চট্টগ্রামেও দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়। মঙ্গলবার চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির একটি সমাবেশে তার প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের কথা ছিল। সে সমাবেশ বাতিল করা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে চট্টগ্রামে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপি নয়াপল্টনস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে মঙ্গলবার বাদ আছর আবদুল্লাহ আল নোমানের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বিএনপি এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর সকল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। বেলা আড়াইটায় জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আরেক দফা নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। মরদেহ চট্টগ্রামে আনার পর আগামী শুক্রবার বাদ জুমা জমিয়তুল ফালাহ মসজিদ প্রাঙ্গণে এবং বাদ আছর রাউজানের গহিরা হাইস্কুল মাঠে জানাজা শেষে তাঁকে গহিরাস্থ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।
উল্লেখ্য, বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার গহিরা গ্রামে জন্ম নোমানের। ছাত্র জীবনে তিনি ছিলেন বামপন্থি রাজনীতিতে সক্রিয়। ৬০-এর দশকে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তিনি যোগ দেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে।
পরে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হলে তিনি মেননপন্থি হিসেবে সংগঠনটির চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বৃহত্তর চট্টগ্রামের সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্র জীবন শেষে তিনি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির অনুসারী হিসেবে শ্রমিক রাজনীতিতে পর্দাপণ করেন। ছিলেন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশনের সহ সভাপতি। পাশাপাশি ভাসানি ন্যাপের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে ন্যাপের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান।
আবদুল্লাহ আল নোমান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ন্যাপেই ছিলেন। এর পর ১৯৮১ সালে বিএনপতে যোগ দেন। ১৯৯১ ও ২০০১ সালে চট্টগ্রাম-৯ থেকে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময় তিনি মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ, শ্রম ও কর্মসংস্থান, বন ও পরিবেশ এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। একজন পরিচ্ছন্ন ও অসম্প্রদায়িক চিন্তার রাজনীতিবিদ হিসেবে তার সুনাম রয়েছে।
তারেক রহমান-মির্জা ফখরুলের শোক ॥ আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রমহান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার সকালে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তারা শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন। এক শোকবার্তায় তারেক রহমান বলেন, ‘মরহুম আবদুল্লাহ আল নোমান একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশের সকল ক্রান্তিকালে জনগণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।
তিনি একজন জাতীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশবাসীর নিকট অত্যন্ত সমাদৃত ছিলেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান বীর উত্তমের নীতি ও আদর্শে গভীরভাবে আস্থাশীল এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শনে বিশ্বাসী মরহুম আবদুল্লাহ আল নোমান বিএনপির প্রতিষ্ঠাকাল থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে একজন আপোসহীন যোদ্ধা হিসেবে নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। জনসেবার মহান লক্ষ্য সামনে নিয়ে রাজনীতি করতেন বলেই সরকারের মন্ত্রী হয়ে নিজ এলাকাসহ সারাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ব্যাপক অবদান রেখেছেন।’
প্রধান উপদেষ্টার শোক ॥ বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে শোক জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার এক শোকবার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আবদুল্লাহ আল নোমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন গুণী নেতা ছিলেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
ষাটের দশকের শুরু থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত রাজনীতিতে সক্রিয় থেকেছেন আবদুল্লাহ আল নোমান। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে (বিএনপি) সক্রিয় থেকে তিনি চট্টগ্রাম-৯ আসন থেকে তিনবার সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হয়েছেন। সাবেক এই মন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মৎস্য ও খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনৈতিক ঘরানার বাইরেও চট্টগ্রামে সব দলমতের মানুষের কাছে শ্রদ্ধার আসনে ছিলেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টা আবদুল্লাহ আল নোমানের আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন ও শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এছাড়া সাবেক আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন সদ্য পদত্যাগী তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আবদুল্লাহ আল নোমান ছিলেন একজন ত্যাগী রাজনীতিবিদ। রাজনৈতিক অঙ্গনে তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন নেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
বিএনপি নেতা আবদুল্লাহ আল নোমানের মৃত্যুতে চট্টগ্রামের সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মৃত্যুতে শোকা করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইদ্রিস মিয়া, সদস্য সচিব হেলাল উদ্দিন এবং বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনগুলোর জেলা পর্যায়ের নেতারা।
চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি রিয়াজ হায়দার চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক সবুর শুভ পৃথক বিবৃতিতে শোক প্রকাশ করেছেন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), ইস্ট ডেল্টা ইউনির্ভাসিটি, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শোক প্রকাশ করা হয়েছে।