
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
পিলখানা হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত ছিল বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মঙ্গলবার সকালে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে বনানীর সামরিক কবরস্থানে শহীদ সেনা সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ অভিযোগ করেন। বিকেলে আরেক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে দেশে শান্তি ফিরবে।
ফখরুল বলেন, অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনকভাবে তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ছিল। আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, যথা সময়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ঘটনাগুলো করতে দেয়। যে কারণে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের যোগসূত্রে দুই দিন ধরে পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ চলতে থাকে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর শত্রুরা চক্রান্ত করে বিডিআরের অভ্যুত্থানের নাম করে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নষ্ট করে দেওয়া। তাই তারা নিরাপত্তাব্যবস্থাকে তছনছ করে দেওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের শত্রুদের উদ্দেশ্যই ছিল নিরাপত্তা ব্যবস্থায় আঘাত হানা। সেনাবাহিনীর মনোবল যাতে নষ্ট হয়, দুর্বল হয়ে যায়। আজকের দিনে নিহত সেনা সদস্যদের স্বজনদের প্রতি সমবেদনা জানাই।
ফখরুল বলেন, ২৫ ফেব্রুয়ারি দেশের সেনাবাহিনীর জন্য কালো দিন। আজ পর্যন্ত পিলখানা হত্যাকা-ের পূর্ণাঙ্গ, সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ, তারা অন্তত ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করেছে। আমরা প্রত্যাশা করছি এ ঘটনার পূর্ণাঙ্গ, সঠিক ও নিরপেক্ষ তদন্ত হবে। সঠিক বিষয়টি উদঘাটন করা হোক। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ও দায়ী, তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। আমরা স্বাধীনতার প্রশ্নে যেন আপোস না করি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, সেনা সদস্যদের এ ত্যাগ বৃথা যাবে না এবং বাংলাদেশ সত্যিকারের স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। তিনি বলেন, দেশে আজ সবাই ঐক্যবদ্ধ। দেশে আজ একটা বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে উৎখাত করে একটি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন।
শহীদ সেনাসদস্যদের আত্মত্যাগ যেন বিফলে না যায়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কেউ যেন আপোস না করেন। আমরা যেন বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারি- এই হোক আজ আমাদের প্রতিজ্ঞা।
এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত প্রমুখ।
এদিকে মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বিএনপি আয়োজিত পিলখানা হত্যাকা- নিয়ে আয়োজিত শোক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দ্রুত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বলেন, জনগণের নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে দেশে শান্তি ফিরবে। এখন কাদা ছোড়াছুড়ি করে ঐক্য নষ্ট না করার আহ্বান জানান তিনি। সেই সঙ্গে তিনি অন্তর্বর্তী সরকারকে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে ন্যূনতম সংস্কার শেষে নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানান।
কিছু মানুষ দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা করছেছে অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, এটা দেশের স্বাধীনতার জন্য শুভ নয়। দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, বিএনপির বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়েছে। তাই নেতাকর্মীদের ধৈর্য্য ধরে এ ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, ২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় সত্যিকার দেশপ্রেমিকের মতো কাজ করার জন্য সেনাবাহিনীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
শক্ত হাতে সরকার পরিচালনা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, কেউ যেন আপনাকে বলতে না পারে যে, আপনি পক্ষপাতিত্ব করছেন। সেটা শুনতে চাই না, কারণ আপনি একজন বিখ্যাত মানুষ। সারা বিশ্বে আপনার নাম রয়েছে। সেটার মর্যাদা রাখবেন এটাই আশা করছি।
আমরা আশা করব সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার যতটুকু প্রয়োজন সেটুকু শেষ করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাবেন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশের স্থিতিশীলতা, শান্তি এবং ভবিষ্যতের জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবেন এটাই প্রত্যাশা করি।
শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ফখরুল বলেন, সেই ১৯৭২ সাল থেকে শেখ মুজিবের প্রতি, আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ঘৃণা তৈরি হয়েছে। কারণ, তারা কোনোদিনই বাংলাদেশের মানুষকে ভালোবাসেনি। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের ফলকেও নস্যাতের ষড়যন্ত্র করছে আওয়ামী লীগ। ভারতে বসে শেখ হাসিনা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।
ফখরুল বলেন, বিডিআর অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে সাহসীকতার সঙ্গে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতেন। বাংলাদেশের সীমান্তকে রক্ষা করার কাজটি তারা করেছেন। সেটাই ছিল তাদের কাজ। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরপরই অত্যন্ত পরিকল্পনার সঙ্গে বিদ্রোহ ঘটিয়েছে। সেদিন ৫৭ জন দেশপ্রেমিক চৌকস সেনাবাহিনীকে তারা হত্যা করেছে।
ফখরুল বলেন, সেনাবাহিনী আমাদের শক্তি। সব সময় আমরা দেখেছি জাতির ক্রান্তিলগ্নে তারা এগিয়ে আসে। আমরা দেখেছি ’৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যখন হামলা করেছে আক্রমণ করেছে মানুষ হত্যা করেছে তখন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে গোটা জাতিকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। সেদিন জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে ফখরুল বলেন, আসুন আমরা শপথ নেই, যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব। যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা রক্ষা করব। আমরা যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনব। আমরা সংগ্রাম করেছি লড়াই করেছি আরও সংগ্রাম-লড়াই করব।
ফখরুল বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশকে সমৃদ্ধভাবে বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে। কিন্তু আজকে আবার সেই সুযোগকে ধ্বংস করার চেষ্টা করা হচ্ছে। পতিত শেখ হাসিনা অবস্থান নিয়েছে দিল্লিতে, সেখান থেকে চক্রান্ত করছে, কি করে এই বিজয়কে নস্যাৎ করে দেওয়া যায়, কীভাবে বাংলাদেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা যায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করলে স্থিতিশীলতা আসবে না। কোনোভাবেই আমরা স্থিতিশীলতা পাব না। তাই, প্রকৃতপক্ষে নিরপেক্ষ বস্তুনিষ্ঠ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকুন। যাতে আমরা একটা গণতান্ত্রিক পর্যায়ে পৌঁছতে পারি।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, অনেকে আমাদের সমালোচনা করে বলেছেন, আমরা নাকি শুধু নির্বাচন নির্বাচন করি। আমরা নাকি সংস্কার করতে চাই না। এতো বড় মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। গুটিকয়েক মানুষ বিএনপিকে টার্গেট করে এ মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে। এরা অপপ্রচার করে বিএনপিকে হেয় করতে চায়। আমরা যেকোনো মূল্যে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করব, স্থিতিশীলতা রক্ষা করব, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনব।
শোক সভায় আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম ও মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত প্রমুখ।