
বইমেলার শেষ সময়ে সন্তানদের নিয়ে পছন্দের বইয়ের খোঁজ করছেন মায়েরা
অমর একুশে বইমেলার শেষ সময় এখন। আর কয়েকদিন হাতে আছে। তার পরই বিদায়। আগামী শুক্রবার আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘোষণা করা হবে। একদিকে তাই ভাঙনের সুর, অন্যদিকে চলছে নানা হিসেব নিকেশ। সব মিলিয়ে কতটা ভালো বা মন্দ হলো এবারের আয়োজন, সাফল্য কী, কোথায় কোথায় ব্যর্থতা- পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার সময় এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছেন লেখক পাঠক প্রকাশকরা।
একেকজন একেকভাবে মূল্যায়ন করছেন বটে। একটি বিষয়ে মনে হলো প্রায় সবাই একমত। সবাই বলছেন, বইমেলা এবার বারোয়ারি মেলার চেহারা পেয়েছে। মূলত হকারদের দৌরাত্ম্য, দখলবাজির কারণেই এমন বদনাম। প্রাণের মেলাকে একেবারে শুরু থেকেই চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ভাসমান দোকানিরা। ছোলা মুড়ি চানাচুর আচার বড়ই ডাব আখ চটপটি ফুচকরা সিদ্ধ ডিম পিঠা আইসক্রিম কাবাব থেকে শুরু করে কাঁচের চুরি সবই বইমেলার অংশ হয়ে গেছে!
মেলার সবগুলো প্রবেশপথ এই দোকানিদের দখলে। অনেকেই ব্যস্ত রাস্তার ওপর চুলা বসিয়ে সেখানে মন দিয়ে পেঁয়াজু পাকুড়া বেগুনি জিলাপি ভাজছেন। তেলভর্তি কড়াই দেখে পিলে চমকে যায় অনেকের। তাতে কী? বাধাহীন বাণিজ্য। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমির মাঝখানের সড়কটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন পাঠক। কিন্তু এ জন্য তাদের রীতিমতো যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়। দু’ হাতে দোকানপাট ঠেলে, জটলা সরিয়ে তবেই প্রবেশ করতে হয় মূল মেলায়।
ভেতরে ঢুকে গেলে খুব নিরাপদ, না, তা-ও নয়। বরং মেলার ভেতরেও বাদাম চানাচুর পেটিস ইত্যাদি ফেরি করে বিক্রি করা হচ্ছে। হকারদের এমন উৎপাতে পাঠক যারপরনাই বিরক্ত। প্রকাশক ছড়াকার হুমায়ূন কবীর ঢালীর একটি মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সোমবার ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, ‘দোয়েল চত্বর থেকে, টিএসসি থেকে এবং ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মেলার গেট পর্যন্ত আসতে আসতে হকারদের হাঁকডাক চিৎকার চেঁচামেচিতে পাঠক বিরক্ত।’
এদিকে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেলার পরিবেশ। এর বাইরে নানাজন নানাভাবে মেলার পরিবেশ এবং ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মেলায় বই বিক্রি নিয়েও আছে হতাশা। প্রকাশকরা বারবারই জানিয়েছেন, আশা অনুযায়ী বই বিক্রি করতে পারননি তারা। সোমবার নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বনামধন্য এক প্রকাশক বলছিলেন, এবারের মেলাটিকে জ্ঞান ও সৃজনশীল বইয়ের মেলা বলে আসলে মনে হচ্ছে না। যেসব বই সারা বছর বিক্রি হয়, চাহিদা থাকে সেসব বইও স্টলে রেখে বিক্রি করা যাচ্ছে না। সেই পাঠক আসছেন না মেলায়।
আরও কিছু কারণে ছন্দপতন ঘটেছে মেলার। একাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল ঘিরে আপত্তি উত্তেজনা দেখা গেছে। বন্ধও করে দেয়া হয়েছে কয়েকটি স্টল। এসব ঘটনার প্রভাব পড়েছে মেলায়। তবে এখন ঠিক অতীত নিয়ে নয়, সামনের দিনগুলো নিয়েই বেশি ভাবা হচ্ছে। মেলার শেষদিকে বড় দুর্ঘটনা ঘটানোর নজির আছে। লেখক প্রকাশকরা তাই নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলা একাডেমির নিরাপত্তা কর্মকর্তা অবশ্য এ বিষয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।
এসবের বাইরে, মেলার মূলমঞ্চেও এবার কিছু পরিবর্তন এসেছে। প্রতিদিনের প্রবন্ধ পাঠ এবং আলোচনা বিষয় নির্ধারণের দিক থেকে আলাদা ছিল, বলা যায়। আলোচনার বাইরে থাকা অনেক বিষয় আলোচিত হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই মঞ্চে। তবে শ্রোতার অভাব কাটানো যায়নি। একই মঞ্চে প্রতিদিন সন্ধ্যায় থাকছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সাস্কৃতিক অনুষ্ঠানে খ্যাতিমান গায়ক গায়িকা নৃত্যশিল্পী আবৃত্তি শিল্পীর অনুপস্থিতি, জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের অভাব ছিল চোখে পড়ার মতো। ‘লেখক বলছি’ মঞ্চের প্রতিদিনের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। সে যাই হোক, সামনের কয়েক দিন মেলা নিয়ে নিশ্চয়ই আরও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করা হবে। আপাতত সেই অপেক্ষা।
৯৮ নতুন বই ॥ ২৪তম দিনে মেলায় ৯৮টি নতুন বই এসেছে বলে জানিয়েছে বাংলা একাডেমি।
মেলা মঞ্চের আয়োজন ॥ বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘জন-আকাক্সক্ষার নাট্যকলা-যাত্রা ॥ ঐতিহ্যের পরম্পরায় জাতীয়তাবাদী শিল্পরীতি এবং অমলেন্দু বিশ^াস’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সাইদুর রহমান লিপন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শাহমান মৈশান। সভাপতিত্ব করেন মিলনকান্তি দে।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশের স্থানীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বৈশিষ্ট্যম-িত রীতি-পদ্ধতির সর্বাধিক জনসম্পৃক্ত একটি নাট্যধারাÑযাত্রা। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যাত্রা শিল্পের জগতে স্বদেশীয় রাজনীতি ও দ্রোহচেতনার বিস্তারে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন অমলেন্দু বিশ্বাস। তাঁর অভিনয় জীবনের প্রারম্ভে রয়েছে নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিম-লে দীর্ঘ এগারো বছরের আধুনিক থিয়েটার চর্চার অভিজ্ঞতা। আধুনিক নাট্যচর্চার জ্ঞানতাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক পরিসরেও ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ।
তিনি বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পে পশ্চিমবঙ্গের মুখাপেক্ষিতা থেকে বের হয়ে দেশীয় নাট্যকারদের দিয়ে নাটলিপি রচনার উদ্যোগ গ্রহণে যাত্রাদলের মালিক ও পরিচালকদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছিলেন। আজীবন তিনি দেশ ও সমাজ সংস্কারে যাত্রাশিল্পকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।
আলোচক বলেন, অমলেন্দু বিশ্বাস যাত্রাশিল্পের একজন কিংবদন্তি। তার অভিনয় হাজার হাজার দর্শককে আপ্লুত করেছে, সম্মোহিত করেছে। তবে তিনি নিছক একজন যাত্রাশিল্পীই ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশেষ এক প্রপঞ্চ। এই সমাজের মধ্যে সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের যে দ্বন্দ্ব আছে তার নিরিখেই অমলেন্দু বিশ্বাসকে বিচার করতে হবে। তিনি যাত্রায় অভিনয় করেছেন, যাত্রার ইতিহাস রচনা করেছেন এবং যাত্রাকে তত্ত্বায়িত করেছেন। সর্বোপরি যাত্রাকে তিনি জনগণের শিল্পভাষা হিসেবে গণ্য করেছেন।
সভাপতির বক্তব্যে মিলনকান্তি দে বলেন, যাত্রাশিল্পের মানসপুত্র হিসেবে অভিহিত করা যায় অমলেন্দু বিশ্বাসকে। তাঁর শিল্প-চেতনায় ছিল লোকজ আঙ্গিকের সঙ্গে আধুনিক নাট্যরীতির সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস। তার অভিনয়, যাত্রা দর্শন ও চিন্তাচেতনা গভীরতর গবেষণার দাবি রাখে।