ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২ ফাল্গুন ১৪৩১

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর ॥ আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস

এখনো অধরা ষড়যন্ত্রকারীরা

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

এখনো অধরা ষড়যন্ত্রকারীরা

অস্ত্র হাতে বিডিআর জওয়ান।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কলঙ্কিত, লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক অধ্যায় পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ১৬ বছর আজ। ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে ৫৭ মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। একক কোনো ঘটনায় এতো সামরিক কর্মকর্তা হত্যাকা- ইতিপূর্বে পৃথিবীর আর কোথাও না ঘটেনি। আন্তর্জাতিকভাবে আলোড়ন ফেলেছিল এ হত্যাকাণ্ড।

অথচ এতো বছরেও অন্ধকারেই রয়ে গেছে হত্যার আসল রহস্য। অধরাই রয়ে গেছে নেপথ্যের যড়যন্ত্রকারীরা। এমনকি দীর্ঘ সময়েও হত্যাকারীদেরও বিচার নিশ্চিত হয়নি। ধুঁকছে বিস্ফোরক আইনের মামলাও। তবে, পটপরিবর্তনের পর বিডিআর হত্যাকা- বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ গঠন হওয়ায় সত্য উন্মোচনে আশার আলো দেখছেন শহীদদের স্বজনরা। কমিশনের তদন্ত শেষ হওয়ার পর সেটি জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন তারা।

২৫ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস ঘোষণা করেছে সরকার। আজ মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হবে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) দিবস উপলক্ষে নানা কর্মসূচি পালন করবে। এছাড়া শহীদদের স্মরণে ঢাকাসহ সারাদেশে দোয়া মাহফিল করবে বিএনপি। 
শহীদদের স্বজনদের অভিযোগ, বিডিআর বিদ্রোহের নেপথ্যের পরিকল্পনকারী ও খলনায়কদের রক্ষা করতে মনগড়া তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিল শেখ হাসিনার সরকার। অথচ পুরো হত্যাযজ্ঞের মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন শেখ হাসিনা নিজেই। তার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে- তার প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ, সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদ, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ সেলিম, শেখ ফজলে নূর তাপস, মির্জা আযম, তোরাব আলীসহ  গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রধানেরা। যাদের অনেকেই বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের দেশে ফেরত এনে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবিও জানিয়েছেন তারা। 
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পিলখানা হত্যাকা-ের ঘটনায় ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দিয়েছেন শহীদদের পরিবার। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় ৩৭ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন। পাশাপাশি ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশন’ এটি তদন্ত করে হত্যাযজ্ঞের নীল নকশার সঙ্গে জড়িতদের নাম ও দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রের অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে।

তদন্তের ক্ষেত্রে বেঁচে ফিরে আসা ব্যক্তি; সামরিক বাহিনী; র‌্যাব ও পুলিশের দায়িত্বশীল ব্যক্তি; ডিজিএফআই; এনএসআই; হুকুমদাতা; সামরিক অপারেশনে বাধাদানকারী; সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়; রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা; বিদেশী সংশ্লিষ্টতা এবং একই সঙ্গে সেনা আইন ভঙ্গের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। 
তদন্তের বিষয়ে ‘জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের সদস্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহনেওয়াজ খান চন্দন বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই। তদন্ত শেষ হলে গোটা জাতি এ বিষয়ে জানতে পারবে।
পিলখানা হত্যাযজ্ঞে নিহত সাবেক বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের ছেলে রাকিন আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, এ হত্যাকা-ে যারা নেপথ্যে থেকে কলকাঠি নেড়েছেন, তারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। যেহেতু ঘটনাটি কমিশন তদন্ত করছে- এই নেপথ্যের খলনায়কদের যেন জাতির সামনে আনা হয়।

আমরা ইতিমধ্যে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক সিদ্দিক, সাবেক সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমেদসহ ৫৮ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল করেছি। তদন্তে যাদেরই সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে তাদেরই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
এ ঘটনায় নির্মমভাবে নিহত কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী মেহরিন ফেরদৌসী বলেন, আমাদেরও তিনটি চাওয়া ছিলো। ‘জাতীয় শহিদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করা, দৃষ্টান্তমূলক বিচার নিশ্চিত করা ও শহীদদের মর্যাদা। দিনটিকে শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করায় আমরা আনন্দিত। তবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কুশীলবদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

যারা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে- তাদের ফিরিয়ে এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে রাজনীতিবিদ ও সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা নেপথ্যে থেকে ষড়যন্ত্র করেছে- তাদের বিচারের আওতায় সর্বাত্মক গুরুত্ব দিতে হবে। 
তিনি আরও বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন তাদের সবার পরিবারই ২৫ ফেব্রুয়ারিকে বিশেষভাবে পালন করে। এজন্য সম্প্রতি আমরা ‘শহীদ সেনা অ্যাসোসিয়েশন’ করেছি। আজ সকালে আমরা বনানী সামরিক কবরস্থানে গিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাবো। এরপর রাওয়া ক্লাবে একটি শোকসভা করা হবে। পরে মিরপুর-২ নম্বরের একটি মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে। 
প্রথমবারের মতো পালিত হবে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস ॥ ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। রবিবার সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এক প্রজ্ঞাপনে এ দিবস ঘোষণা করা হয়। ফলে আজ প্রথমবারের মতো জাতীয় শহীদ সেনা দিবস পালিত হবে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হবে। 
এদিকে জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে বিডিআর বিদ্রোহে নিহতদের স্মরণে ২৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সারাদেশে দোয়া মাহফিল করবে বিএনপি। সোমবার বিকেলে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী একদিনের এই কর্মসূচি করেন।
‘২০০৯ সালের এই দিনে নারকীয় হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল কিছু বিপথগামী সৈনিক। সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) (তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর) সদর দপ্তরে তারা ধ্বংসলীলা চালায়। তাদের হামলায় প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তা এবং নারী, শিশুসহ আরও ১৭ জন।’ 
শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হবে ॥ পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীর শহীদ সেনাসদস্যদের শাহাদাতবার্ষিকী পালিত হবে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিএর) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছে, আজ সকাল ৯টায় শাহাদাতবার্ষিকী পালন উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, তিন বাহিনী প্রধানগণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ও বিজিবি মহাপরিচালক এবং শহীদদের নিকটাত্মীয়গণ বনানী সামরিক করবস্থানে শহীদদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় শহীদ অফিসারদের স্মরণে রাওয়ার হেলমেট হলে বিশেষ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও তিন বাহিনী প্রধানসহ  একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকবেন।
‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’কে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত ঘোষণা ॥ সরকার প্রতিবছর ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং ওই তারিখকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ (সরকারি ছুটি ব্যতীত) হিসেবে পালনের নিমিত্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন সংক্রান্ত পরিপত্রের ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত দিবস হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক ওই দিবসটি যথাযথভাবে প্রতিপালনের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।- আইএসপিআর

×