ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

প্রকাশিত: ২৩:২০, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

মাতৃভাষা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী

খাগড়াছড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্ব-স্ব মাতৃভাষার

খাগড়াছড়িতে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্ব-স্ব মাতৃভাষার  প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়েছে এ ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম। এতে করে দীর্ঘ ৯ বছরেও আলোর মুখ দেখছে না ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা পাঠদান কার্যক্রম। সরকারিভাবে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকা ও ক্লাস রুটিনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না করায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা-এ তিন সম্প্রদায়ের জাতি গোষ্ঠী শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষার শিক্ষা। ম্যানুয়েল তৈরি করে শিক্ষকদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও ক্লাস রুটিনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির দাবি জানিয়েছেন শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা।
প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ঝরে পড়া রোধ করার জন্য পাহাড় আর সমতলে বসবাসকারী  ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের স্ব-স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক থেকে শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিতে মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা হয়। ২০১৭ সালে মাতৃভাষার শিক্ষা চালু হলেও এতদিনেও শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত রয়েছে। 
সরকার দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায়  নিজ মাতৃভাষায় ১ম শ্রেণি থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত পাহাড় আর সমতলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ করে দিলেও  খাগড়াছড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে স্ব-স্ব মাতৃভাষার  প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এ ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম।

স্ব-স্ব মাতৃভাষার প্রশিক্ষিত শিক্ষক না থাকায়, খাগড়াছড়ির অধিকাংশ বিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না মাতৃভাষার বইগুলো। প্রাক-প্রাথমিক থেকে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার বইগুলো পড়ে রয়েছে বিদ্যালয়ের অফিস কক্ষে। অনেক বিদ্যালয়ে নেই স্ব-স্ব মাতৃভাষার শিক্ষক আর অধিকাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নেই প্রশিক্ষণ।

তাই মাতৃভাষার বইগুলো পড়ানো যাচ্ছে না। এ ছাড়া খাগড়াছড়ির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস রুটিনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এ ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম। 
খাগড়াছড়ির আপার পেড়াছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বেনু চাকমা ও খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশা প্রিয় ত্রিপুরা বলেন, বিদ্যালয়গুলোতে স্ব-স্ব মাতৃভাষার শিক্ষক না থাকা ও ক্লাস রুটিনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত না থাকায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এ ভাষা শিক্ষার কার্যক্রম। 
শিক্ষকরা যে বিদ্যালয়ে স্ব-স্ব মাতৃভাষার ওপর  শিক্ষক নেই সেইসব  বিদ্যালয়ে মাতৃভাষার শিক্ষক পদায়ন ও পিটিআই এর মাধ্যমে শিক্ষকদের নিজ নিজ মাতৃভাষার ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং ক্লাস রুটিনে বিষয়টি অন্তর্ভুক্তির অনুরোধ জানিয়েছেন। 
এদিকে বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি শিশুরা জানায়, তারা নিজ নিজ মাতৃভাষায় কথা বলতে পারলেও লিখতে ও পড়তে পারে না। 
ভাষা গবেষক ও এনসিটিবি’র ত্রিপুরা প্যানেল সদস্য মথুরা বিকাশ ত্রিপুরা ও এনসিটিবি’র  চাকমা ভাষার প্যানেল সদস্য আর্য মিত্র চাকমা মাতৃভাষা শিক্ষার বর্তমান অবস্থা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বর্ণমালার সঙ্গে অপরিচিতি, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকা এবং পরিকল্পিত উদ্যোগের অভাবে ৯ বছরেও স্কুলে মাতৃভাষার পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হচ্ছে না।

প্রকৃত অর্থে অনেকটাই দায়সারাভাবে চলছে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রাথমিক শিক্ষা। তাই তারা মাতৃভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে (পিটিআই) তা অন্তর্ভুক্তির ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট-এর তত্ত্বাবধায়ক, রুমা দাশ জানান, কয়েক বছর আগে শিক্ষকদের ভাষাভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও এখন তা বন্ধ রয়েছে। তা ছাড়া দক্ষ প্রশিক্ষকেরও অভাব রয়েছে। তিনি বলেন, মাতৃভাষায় শিক্ষার জন্য যে বিদ্যালয়ে যে ভাষার শিক্ষার্থী আছে সেই বিদ্যালয়ে সেই ভাষার শিক্ষক পদায়ন ও নিজ নিজ মাতৃভাষার ওপর প্রশিক্ষিত করা গেলে সরকারের এ উদ্যোগের সফলতা আসবে।
মূলত দক্ষ কোনো প্রশিক্ষক না থাকার কারণে এক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই বলে মনে করেন খাগড়াছড়ির জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম। তা ছাড়া পার্বত্য জেলা পরিষদগুলোও এ বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে জানান তিনি। এ দুই কর্মকর্তাই বিষয়টি অধিদপ্তরকে জানানোর দাবি করেন। 
এদিকে সরকার ২০১৭ সালে প্রাক-প্রাথমিক, ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণি, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণি ও ২০২০ সালে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরাদের মাতৃভাষায়  প্রাথমিক শিক্ষা চালু করে। 
মাতৃভাষার শিক্ষক পদায়ন ও মাতৃভাষার শিক্ষা ব্যবস্থাকে টেকসই করার জন্য ম্যানুয়েল তৈরি করে শিক্ষকদের পিটিআইয়ের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে; এমনটাই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্টদের।-জীতেন বড়ুয়া, খাগড়াছড়ি

×