
একুশের আয়োজনের জন্য প্রস্তুত পুরনো আদলে সংস্কার করা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার
আগামীকাল ২১ ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস- বাঙালির জাতিসত্তা ও ভাষাভিত্তিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষাসহ সকল সংগ্রাম ও আন্দোলনের প্রেরণার দিন। জাতিসংঘের ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, এ দিবস ‘১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের মানুষের অভূতপূর্ব আত্মত্যাগের স্বীকৃতি’।
একুশের আয়োজন মানে শহীদ মিনারে মানুষের বাঁধভাঙা ¯্রােত। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে সবাই উপস্থিত হন মিনারের বেদিমূলে। দিবসের প্রথম প্রহর থেকে শিশু-কিশোরসহ সকল বয়সী নারী-পুরুষ ছুটে চলেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য। ফুলে ফুলে ঢেকে যায় প্রাণের শহীদ মিনার। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্থায়ী শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন সবাই।
তবে, প্রায় তিনবছর ধরে দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামে একুশের মূল কর্মসূচিটি চলে আসছিল মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুলের অস্থায়ী মিনারে। এ সময় সংস্কার কাজের জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বন্ধ ছিল। সংস্কার শেষেও নানা জটিলতায় পুরাতন শহীদ মিনারটি খুলে না দেওয়ায় সাংস্কৃতিক মহলে ছিল সমালোচনা। তবে, নতুন সিটি মেয়র দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর ঘোষণা দেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেই ফিরে যাবে মূল আয়োজন।
অবশেষে এবার একুশের আয়োজন আবার ফিরছে তার মূল জায়গায়। ইতোমধ্যে ভাষা ও সংস্কৃতিপ্রেমীদের জন্য সম্পন্ন হয়েছে সকল প্রস্তুতি। এখন শেষ মুহূর্তের অপেক্ষা। জানা যায়, নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন কে সি দে রোডের পাহাড়ের পাদদেশে ১৯৬২ সালে প্রথম শহীদ মিনারটি নির্মাণ করা হয়। পরে ১৯৭৪ সালে এর নতুন রূপ দেওয়া হয়। বিগত সরকারের সময় চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্সের সঙ্গে শহীদ মিনারের সংস্কার কাজ শুরু হয়।
কিন্তু মিনারের আকৃতি নিয়ে শুরু হয় বিভিন্ন পক্ষের আলোচনা-সমালোচনা। অবশেষে পুরাতন শহীদ মিনারের আদলেই নতুন শহীদ মিনার নির্মাণ ও উন্মুক্ত গ্যালারির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর কথা চূড়ান্ত হয়। গত মঙ্গলবার সকালে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে এসে ঘোষণা দেনÑ ‘২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধা জানাতে পারবে নগরবাসী।’ এজন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।
এরই অংশ হিসেবে পরিচ্ছন্নতা ও রঙের কাজও সম্পন্ন করেছে চসিক। এর আগে নির্মাণ কাজ শেষ হলেও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটির নকশা নিয়ে ২০২৩ সালের নভেম্বরে আপত্তি জানায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। এরপর একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয় সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর নেতৃত্বে। ওই কমিটি নকশা সংশোধন করে ১০টি সুপারিশ করে। তবে, সেগুলোর আর কোনো অগ্রগতি হয়নি।
চট্টগ্রামে বড় একটি শহীদ মিনারের দাবি ছিল নগরবাসীর। একসময় জেলার সকল আন্দোলন সংগ্রামের মূলস্থল ছিল শহীদ মিনার। অবস্থান কর্মসূচি কিংবা ছাত্র সমাবেশ সবকিছুই শহীদ মিনারকেন্দ্রিক হতো। মুসলিম হলের বিপরীতে কে সি দে পাহাড় সংলগ্ন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশেই অনেক ছাত্র সংগঠনের সমাবেশ, সম্মেলন হয়েছে। এ ছাড়া, সাংস্কৃতিক ও গণসংগঠনগুলোর আলোচিত অনুষ্ঠান এবং দাবি-দাওয়া নিয়ে সকলের সম্মিলিত প্রতিবাদস্থল হিসেবে চট্টগ্রামের শহীদ মিনার ছিল সুপরিচিত।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের অধীনে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পে ২৩২ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। পরে ব্যয় বৃদ্ধি করে ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা করা হয়। প্রকল্পের পাবলিক লাইব্রেরি ও মুসলিম ইনস্টিটিউট হল অংশের সঙ্গে সড়কের বিপরীত পাশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার অংশকে একটি প্লাজা দিয়ে যুক্ত করার নক্সা করা হয়।
ওই নকশা অনুসারে সড়কের ওপর দিয়ে প্লাজা নির্মাণের জন্য আগের শহীদ মিনারটি ভেঙে ভিত্তি উঁচু করে একই আদলে নতুন শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। ২০২১ সালে মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের উপস্থিতিতে সাংস্কৃতিক কর্মীদের সঙ্গে সভা করে পুরনো শহীদ মিনারটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়।
সে অনুযায়ী ২০২১ সালের জানুয়ারিতে পুরনো শহীদ মিনার ভাঙা শুরু হয় এবং মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল মাঠে অস্থায়ী শহীদ মিনার নির্মাণ করে দেয় প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর। সেই থেকে অস্থায়ী শহীদ মিনারে জাতীয় দিবসগুলোতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতো।
গত বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল মাঠের অস্থায়ী শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ অন্যান্য কর্মসূচি পালন করেছিল চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। আর উত্তর কাট্টলীতে অস্থায়ী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছিল চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।