ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

ভরাট হচ্ছে নদী, নষ্ট হচ্ছে ফসলি জমি

প্রতিবছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনছে তিস্তা

তাহমিন হক ববী, নীলফামারী

প্রকাশিত: ০০:৪৩, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

প্রতিবছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনছে তিস্তা

নীলফামারীতে তিস্তা নদীর ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের উজান ও ভাটিতে নদীর চিত্রটি মঙ্গলবার তোলা হয়

তিস্তা নদী তার গভীরতা হারিয়ে ফেলেছে। বছর বছর নদী উঁচু হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উজানের ঢলের সঙ্গে প্রতিবছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে তিস্তা নদী। এতে করেই তিস্তা নদীর বুক ভরাট হচ্ছে। আবার  স্বল্প বৃষ্টিতেই নদী অববাহিকা হচ্ছে প্লাবিত। এতে চরের ফসলি জমি নষ্ট হচ্ছে।
নদীপাড়ের মানুষজন জানায়, ২০২৩ সালে ৩ অক্টোবর রাতে ভারতের সিকিমের একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছিল। ওই সময় যে ঢল এসেছিল, তার সঙ্গে ব্যাপক মাটিও ভেসে আসে। ওই মাটির কারণে নদীর পানি ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঘোলা ছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান  বলেন, পাহাড়ি ঢল থেকে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিবছর তিস্তা নদী দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে। ফলে, তিস্তা নদীর বুক উঁচু হয়েছে। তাই অল্প পানিতে বন্যা দেখা দিচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি থাকছে না। 
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, সিকিমে ২৪টি বাঁধ দেওয়া হয়েছে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য। তার মধ্যে শুধু তিস্তার ওপরেই ইতোমধ্যে ৬টি প্রকল্প তৈরি হয়ে গেছে। কতক বাঁধের জন্য তিস্তা প্রায় শুকিয়ে গেছে। এগুলো রান অব দ্য রিভার প্রকল্প। কিন্তু আসলে তারা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ করে দিয়ে সুরঙ্গ দিয়ে ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নদীর পানি নিয়ে যাচ্ছে।’
উত্তরপূর্ব ভারত নদীগুলোতে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করছে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘কল্পবৃক্ষ’। সেখানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরেই জলস্রোত আবারও নদীর প্রবাহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়, সেটা ঠিক। কিন্তু তিস্তার ওপরে এতটা বাঁধ তৈরি হয়েছে যে, কোনো না কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জলপ্রবাহ বন্ধ থাকছেই। একটা প্রকল্প থেকে জল ছাড়ার পরে অন্য প্রকল্পে আটকানো হচ্ছে।

তাই গোটা নদীতেই তার প্রভাব পড়ছে। পাহাড় থেকে তিস্তার পানি সেবক হয়ে জলপাইগুড়ির গজলডোবায় এসেছে। সেখানেই আবার তৈরি হয়েছে ভারতের ৫৪ গেটের তিস্তা ব্যারাজ। সেখানেও তিস্তার পানি আটকিয়ে রেখে ওই পানি সেচ ও শহরের বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। ফলে, গজলডোবার পরের অংশ বাংলাদেশে তিস্তার পানি সঠিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে না।

সূত্র বলছে, যখন বর্ষাকাল শুরু হয় তখন গজলডোর জলাধারে  প্রয়োজনীয় পানি রেখে বাকি পানি বাংলাদেশের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে ভারত। ফলে, বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে। আবার শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবার বন্ধ রাখা ৫৪ গেটের চুয়ানো পানি দিয়ে বাংলাদেশের তিস্তা চলছে। এতে নদীর বুকে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হচ্ছে তিস্তা। 
নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, ১৭৮৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় তিস্তা নদীর প্রবাহের সৃষ্টি। ২৩৯ বছর আগে তৈরি হওয়া এ নদীর আজ অবধি কোনো পরিচর্যা করা হয়নি।

ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান পর্ব ও বাংলাদেশ যুগের কোনো সময়েই এ নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বরং দফায় দফায় এ নদীর সর্বনাশ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে, যে নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তরের জীবনরেখা, সেটা হয়ে উঠেছে অভিশাপ। নদীকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ তিস্তা নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদী। এটি নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি।

তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না। বন্যার সময় তিস্তায় মিনিটে ৪ লাখ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। পাশাপাশি প্রতিবছর উজানের ঘোলা পানির সঙ্গে আসা পলি, পাথরসহ ময়লা-আবর্জনায় তিস্তার বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নদীর বুক উঁচু হয়ে গেছে। ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তার পানি ভারত গজলডোবা বাঁধ দিয়ে আটকে না রাখলে তা বঙ্গোপসাগরে চলে যেত।

একদিকে পানির প্রবাহ নেই, অপরদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। তাই সাগরের লবণাক্ত পানি দিন দিন লোকালয়ে উঠে আসছে। লবণাক্ত পানির কারণে দক্ষিণবঙ্গে আমাদের ফসল আবাদ হচ্ছে না। এ ছাড়া পানির কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তিনি বলেন, গত দুইদিন তিস্তা পাড়ে যে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। তার দাবি অচিরেই সমাধানে সরকারকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। যদিও শুনেছি চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই একটি জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে।

তারপর চীনের মাধ্যমে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এটি বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের ভালো উদ্যোগ। তবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিস্তার পানি হিস্যা পর্বটি অধিক জরুরি। তাই বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী  বলেন, ভারত থেকে ধেয়ে আসা উজানের ঢলে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা অববাহিকায় প্রায়ই অসময়ে বন্যা হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙনের ভয়াবহতায় এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে। খরাকালে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখে ভারত।

আবার একটু পানি বেশি হলেই বাংলাদেশকে কিছু না জানিয়ে গজলডোবার গজবে ভাসাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষদের। এতে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে খাদ্যনিরাপত্তা। নদীভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা। তিনি আরও বলেন, আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা অববাহিকায় ভারত-বাংলাদেশ মিলে নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারা এবং দেশীয় ব্যবস্থাপনায় নদী খনন, ভাঙন রোধে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারে বসবাসরত দুই কোটি মানুষের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে।

এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা অমলেশ চন্দ্র রায় জানান, বর্তমানে তিস্তার পানি প্রবাহ আড়াই হাজার কিউসেক রয়েছে। এই পানি তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট বন্ধ রেখে তিস্তা সেচ ক্যানেলে নেওয়া হচ্ছে।  সেই পানিতে ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের কার্যক্রম চলমান।

×