
অমর একুশে বইমেলায় পছন্দের বইয়ের খোঁজে দুই তরুণী
বইমেলার বেশিরভাগ দিন একভাবে শুরু হয়। একভাবেই শেষ হয়। একটি দিনের সঙ্গে অন্য দিনের খুব একটা পার্থক্য করা যায় না। তবে বিশেষ দিবসের কথা আলাদা। বিশেষ দিবসগুলোর সরাসরি প্রভাব পড়ে মেলায়। লোকসমাগম কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এই যেমন কদিন আগে পহেলা ফাল্গুনে বাসন্তী রঙে সেজেছিল গোটা প্রাঙ্গণ।
একদিকে বসন্ত উৎসব, অন্যদিকে ভালোবাসার মাতাল সমীরণ। তরুণ তরুণীরা তাই চমৎকার সেজে মেলায় এসেছিলেন। তাদের প্রাণবন্ত উপস্থিতিতে চেনা ছবি আমূল বদলে গিয়েছিল। ওই দিনের আনন্দ উচ্ছ্বাসের রেশ ছিল টানা কয়েকদিন।
তবে বইমেলার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি নিঃসন্দেহে ২১ ফেব্রুয়ারি। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাঙালি অবিস্মরণীয় এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল। ভারত ভাগের পর ১৯৪৮ সাল থেকেই বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে পাকিস্তানিরা। এ দেশীয় সংস্কৃতির ওপর কঠিন আঘাত হানে তারা। এর অংশ হিসেবে মায়ের ভাষা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয় জিন্নাহ।
বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়েই এই দুঃসাহস সে দেখিয়েছিল। জবাবও পেয়েছিল তৎক্ষণাত। বড়সর প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল বাঙালি। ধারাবাহিক প্রতিবাদের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫২ সালে ঘটে হৃদয়বিদারক ঘটনা। ২১ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানিদের ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নেমে আসেন ছাত্ররা। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগানে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। ঠিক তখন নির্বিচারে গুলি ছোড়ে পাকিস্তানি বর্বর গোষ্ঠী।
বরকত রফিক শফিক সালাম জব্বাররা লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। রক্তে ভেসে যায় মাটি। তরুণ তাজা প্রাণের বিনিময়ে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। এই ভাষাবোধ ভাষা চেতনার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে অমর একুশে বইমেলা। প্রতিবছর এই দিনে শহীদ মিনারের জন¯্রােত মেলায় এসে আছড়ে পড়ে।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি’ গাইতে গাইতে মেলায় প্রবেশ করে বিভিন্ন বয়সী মানুষ। বিপুল লোকসমাগম হয় এদিন। বইও বিক্রি হয় প্রচুর। সব মিলিয়ে একুশের দিন পূর্ণতা পায় একুশের মেলা।
১৯তম দিনে মেলা ঘুরে দেখা গেছে ২১ ফেব্রুয়ারির জন্য আলাদাভাবে অপেক্ষা করছেন সবাই। সাবিনা ইয়াসমিন রুনা নামের এক তরুণী বলছিলেন, একুশের দিন মেলায় ভিড় বেশি হয়। তার পরও ওই দিন না এলে কেমন যেন অপূর্ণ লাগে। এবারও তাই ২১ ফেব্রুয়ারি বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে মেলায় আসবেন বলে জানান তিনি।
নাঈম নামের আরেক তরুণ সঙ্গে থাকা মেয়ে বন্ধুটির হাত ধরে জানতে চাইলেন, আজ তো এলেই। ২১ ফেব্রুয়ারি আবার আসতে হবে? জবাবে তরুণীর উত্তর: অবশ্যই। ওই দিন পরার জন্য কালো একটা শাড়ি আমি তুলে রেখেছি! শাড়িতে শোকানুভূতির যেমন প্রকাশ ঘটবে, তেমনি স্মরণ করব গর্বের সেই ইতিহাস।
প্রকাশকরাও এদিনের জন্য জোর প্রস্তুতি নিয়েছেন। যতদূর জানা গেছে, বেশিরভাগ প্রকাশক ২১ ফেব্রুয়ারির আগে গুরুত্বপূর্ণ সব বই মেলায় আনতে দিন রাত কাজ করছেন। সব ঠিক থাকলে গত দিনগুলোর তুলনায় এদিন বেশি বই বিক্রি করতে চান বলে জানিয়েছেন একাধিক প্রকাশক।
৭০ নতুন বই ॥ ১৯তম দিনে মেলায় ৭০টি নতুন বই আসার তথ্য দিয়েছে বাংলা একাডেমি।
মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই’ শীর্ষক আলোচনা। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জুলফিকার শাহাদাৎ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন শাহাবুদ্দীন নাগরী। সভাপতিত্ব করেন সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ।
প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলা শিশুসাহিত্যে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই এক মহীরুহ। শিশুদের চিত্তবৃত্তির উন্মেষ ও প্রতিভার বিকাশ সাধনে তাঁর ছিল নিরলস প্রয়াস। তিনি নিজে যেমন শিশুদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন, তেমনি শিশুদের মধ্যেও স্বপ্নের বীজ বুনতেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিশুদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তিনি ‘কচি-কাঁচার মেলা’র মাধ্যমে সারাদেশে শিশুদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মকা- ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তিনি নিজে শিশুদের জন্য ছড়া লিখতেন এবং বিখ্যাত লেখকদেরও উৎসাহ দিতেন শিশুদের উপযোগী সাহিত্য রচনার জন্য। দাদাভাই তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের মধ্যে নীতিজ্ঞান, দেশপ্রেম ও চারিত্রিক গুণাবলি জাগ্রত করার চেষ্টা করতেন।
আলোচক বলেন, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাইয়ের কাজের ব্যাপকতা ছিল অনেক। লেখক, ছড়াকার ও সংগঠক ছাড়াও তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হলো তিনি বাংলাদেশের একজন কিংবদন্তিতুল্য সম্পাদক। শিশু-কিশোরদের সংগঠনের আওতায় এনে তাদের মানসিক উৎকর্ষ সাধনে দাদাভাই সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি ছিলেন লেখক তৈরির কারিগর। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের অনেক বিখ্যাত লেখক সাহিত্য জগতে আবির্ভূত হয়েছেন।
সভাপতির বক্তব্যে সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ বলেন, শিশু-কিশোরসহ সকল বয়সী মানুষের অতি প্রিয় মানুষ ছিলেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। শিশুদের আদর্শবান করে গড়ে তোলার জন্য তিনি যে ভূমিকা রেখেছেন তা অবিস্মরণীয়। তাঁর কথা, কাজ ও আদর্শ আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
লেখক বলছি ॥ এই মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন- মাহমুদউল্লাহ, কাজল রশীদ শাহীন এবং তুহিন খান।