ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ৯ ফাল্গুন ১৪৩১

বরিশালের বাকেরগঞ্জে ৩৬৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার, আজও অরক্ষিত!

নিজস্ব সংবাদদাতা, জিয়াউল হক

প্রকাশিত: ১৫:৪৪, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বরিশালের বাকেরগঞ্জে ৩৬৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নেই শহীদ মিনার, আজও অরক্ষিত!

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলায় ৩৬৪ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই। উপজেলায় ২৮৯টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও মাত্র ১৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার রয়েছে, বাকি ২৭৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই শহীদ মিনার। এ ছাড়াও ৮৪টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও শহীদ মিনার রয়েছে ৫৬টিতে, বাকি ২৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার নেই। এ ছাড়াও এই উপজেলায় ২৪টি কলেজ থাকলেও ১৬টি কলেজে শহীদ মিনার রয়েছে, বাকি আটটি কলেজে নেই শহীদ মিনার। উপজেলায় ৬৩টি মাদ্রাসা থাকলেও মাত্র আটটি মাদ্রাসায় রয়েছে শহীদ মিনার, বাকি ৫৫টি মাদ্রাসায় শহীদ মিনার নেই।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম জানান, আমি উপজেলা সমন্বয় মিটিংসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রয়েছে, শহীদ মিনার নির্মাণে কার্যকর কোনো ভূমিকা নেই কারও। 

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা এ বি এম জাহিদ হোসেন জানান, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকা দরকার, তবে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই তারা অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার তৈরি করে একুশে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে।

এছাড়াও ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছরেও আজও অরক্ষিত বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার প্রথম শহীদ মিনারটি। ভাষা শহীদদের স্মরণে ১৯৬৯ সালে বাকেরগঞ্জ মাদ্রাসা রোড, কাঠের পোল নামক স্থানে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়। 

শহীদ মিনারটি নির্মাণ করেন বাকেরগঞ্জ পৌর এলাকার ৯ নং ওয়ার্ডের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: শাহজাহান জোমাদ্দার। শহীদ মিনারটি পৌর সভার ৪ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি শহীদ মিনারটি সারাবছরই অযত্নে-অবহেলায় আর নোংরা হয়ে পড়ে থাকে। উপজেলা প্রশাসনের নাকের ডগায় শহীদ মিনারটি স্থানীয় কিছু লোকজন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, শহীদ মিনারটি ঘেঁষে কয়েকটি চায়ের দোকান গড়ে উঠেছে। দোকানে আসা প্রতিদিনের কাস্টমাররা শহীদ মিনারের উপর অবস্থান করে। কয়েকজন চায়ের দোকানদারেরা শহীদ মিনারের উপর টুল বসিয়ে দোকানদারি করছেন এ কারণে ভেঙে গেছে শহীদ মিনারের নিচের অংশ। উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা সহ সুশীল সমাজের দাবি অনতিবিলম্বে এটাকে সংস্কার করা হোক।

মুক্তিযোদ্ধা মো: শাহজাহান জোমাদ্দার জনকণ্ঠকে জানান, ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, তৎলীন ছাত্র-জনতা উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে আসে বাকেরগঞ্জ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাষা শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার শহীদ মিনার নির্মাণ করতে দেয় না। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার জন্য ছাত্র নেতৃবৃন্দ শহীদ মিনার তৈরির জন্য আবারো সোচ্চার হয়। তৎকালীন সময়ে আমি উপজেলার ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম। তৎকালীন সময়ের বাকেরগঞ্জ উপজেলার সাব রেজিস্টার আমির হোসেন চৌধুরীর পুত্র মেহেদী হাসান চৌধুরী ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি দায়িত্বে ছিলেন। 

তৎকালীন সময় স্থানীয় মেম্বার সাদেম আলী খান এই শহীদ মিনারটির জন্য ২ শতাংশ জমি দান করেন। পাকিস্তান সরকারের রক্তচক্ষ উপেক্ষা করে আমরা এই শহীদ মিনারটি নির্মাণ করি। ১৯৬৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি ১১ দফা আন্দোলে নেতৃত্ব দেই। এবং শহীদ মিনার নির্মাণকে কেন্দ্র করে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ থানার ওসি মালেক আমাকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে পাঠায়। আন্দোলন সংগ্রাম করে যে শহীদ মিনার  আমরা নির্মাণ করি তা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

স্থানীয়রা জানান, বাকেরগঞ্জ প্রথম শহীদ মিনার আমাদের পূর্বপুরুষদের ইতিহাস, লড়াই-সংগ্রাম, গৌরবের প্রামাণ্য দলিল, ঐতিহ্যের অংশ। এই শহরের প্রাচীন কোন নিদর্শনতো আর নেই। লজ্জাকর মুর্খতায় একটা একটা করে সবকিছুকেই আমরা নষ্ট করেছি, হারিয়ে ফেলেছি। এই শেষ নিদর্শনটুকুকে হারাতে দেয়া ঠিক হবে না। আপাত দৃষ্টিতে প্রথম শহীদ মিনারের গুরুত্ব নেই মনে হলেও এর ঐতিহাসিক মূল্য অসীম। আমরা এখন যত দৃষ্টনন্দন স্থপনা, স্মৃতিস্তম্ভ, শহীদ মিনারই বানাই না কেন তার কেবল নান্দনিক মূল্য থাকবে কিন্তু এগুলোর সঙ্গে কোন ইতিহাস নেই, গৌরব নেই, প্ররণা নেই। তাই আমরা মনে করি যে কোন মূল্যে আমাদের প্রথম শহীদ মিনারকে টিকিয়ে রাখতেই হবে। এই শহীদ মিনারকে বাঁচিয়ে রাখাটা বাকেরগঞ্জের বিবেকবান মানুষের দায়, জনপ্রতিনিধি সহ উপজেলা প্রশাসনের দায়।

বাকেরগঞ্জ পৌর প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা আফরোজ বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শহীদ মিনার না থাকার বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। শহীদ মিনার দেখেও তার উপর যাহারা বসেন তাদের সাধারণ জ্ঞানের অভাব রয়েছে। নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে উপজেলার প্রাচীন শহীদ মিনারটি সংস্কার করা হবে।

 

রাজু

×