ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে করাতি সম্প্রদায়

শরিফুল রোমান, মুকসুদপুর।

প্রকাশিত: ১২:৪২, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

কালের আবর্তে হারিয়ে যেতে বসেছে করাতি সম্প্রদায়

ছবি: সংগৃহীত।

প্রাচীন যুগে মানুষ বনে-জঙ্গলে এমন কি পাহাড়ের গুহায় বসবাস করতো। মধ্যযুগে এসে মানুষ যখন কিছুটা সভ্যতার ছোঁয়া পায়, তখন মানুষের চিন্তা ও রুচির পরিবর্তন আসে। বনের কাঠ-বাঁশ, ডালপালা, লতাপাতা দিয়ে ঘর বানাতে শুরু করে।

সমাজকাঠামো পরিবর্তনের সাথে সাথে  মননশীলতায়ও আমুল পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে মানুষ সৌন্দর্যপ্রিয় হয়ে উঠার সাথে রুচিরও পরিবর্তন আসে। আর তখন থেকেই নিরাপদ বসবাসের জন্য শুরু হয় ঘরবাড়ি নির্মাণ। সুন্দর ও মজবুত বাড়ি নির্মানের  প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে  উন্নত কাঠের। তখনও  মানুষ গাছ কর্তনের আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার শেখেনি। তারা নিজেদের মত করে বিভিন্ন উপায়ে কাঠ চেরাইয়ের কৌশল বের করে ফেলে। 

সভ্যতার বিবর্তনে এক সময় আবিষ্কার হয়ে যায় লোহার হাত করাতের। তারপর থেকেই প্রচলন শুরু হয় বড় করাত দিয়ে কাঠ চেরাইয়ের। অনেকে কাঠ চেরাইকে পেশা হিসেবেও বেছে নেয়া শুরু করে।  সমাজে গড়ে ওঠে করাতি সম্প্রদায়। কিন্তু সভ্যতার শুরুতে গড়ে ওঠা সেই করাতি সম্প্রদায়ের পেশা আজ হুমকির মুখে। বলা যায় বিলুপ্তিপ্রায়। অঞ্চলভেদে করাতি সম্প্রদায়ের হাতেগোণা দু-একটি পরিবার ধরে রেখেছে তাদের এই পূর্বপুরুষের পেশাকে। তবে, যান্ত্রিক করাত কলের বিস্তার ঘটায় এখন তাদের আর আগের মতো কদর নেই। একসময় সারা বছর গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাঠ চেরাইয়ের কাজ করতো তারা। গ্রামের পথে ঘাটে হাটলে প্রায় বাড়িতেই শোনা যেতো হাত করাতের টানের এক অন্যরকম ছন্দ। কিন্ত এখন তা অতীত। অনেকে জীবিকার এই পেশাকে পরিবর্তন করে অন্য পেশায় চলে গেছে। বর্তমানে অন্য পেশার পাশাপাশি বছরের মাত্র কয়েক মাস এই কাঠ চেরাইয়ের কাজ করে তারা। 

গনেশ মন্ডল জানান, মানুষ এখন সবকিছু সহজে করতে চায়।তাছাড়া বেশিরভাগ মানুষ পাকা বাড়ি তৈরী করছে। কাঠের ঘর খুবই কম হয়। তাই আমাদের আগের মতোন কদরও নেই। করাতির কাজ করে এখন সংসারও চলে না! 

এ অঞ্চলে  বর্তমানে চার-পাঁচটি পরিবার এই পেশায় নিয়োজিত আছে। যান্ত্রিক করাত এবং হাত করাতে কাঠ কাটার গুণগত কোনো পার্থক্য আছে কি না জানতে চাইলে তারা বলেন, হাত করাতে কাঠের আশ ধরে কাটা হয়। একারণে কাঠ মজবুত হয়। মালের পরিমানও বেশি হয়। আর কারেন্টের মিলে কাটলে কাঠের অপচয় হয় বেশি। মিলে যেভাবে খুশি সেভাবেই কাটার ফলে দেখতে সুন্দর হলেও আশ কেটে কাঠ দুর্বল হয়ে যায়। তাছাড়া, হাত করাত পরিবেশ বান্ধব। আগের যুগে হাত করাত দিয়ে কাটা কাঠের ঘর একশ’-দেড়শ’ বছর বয়স পেতো।কিন্তু এখন বছর যেতে না যেতেই কাঠের ঘর ভেঙে পড়ে। যারা হাত করাতে কাটার গুনাগুণ সম্পর্কে জানে-বোঝে তারাই আমাদেরকে ডাক আগের কালে সবাই কাঠ দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরী করতো। এজন্য হাত করতিরাই ছিল একমাত্র ভরসা। এখন এই সম্প্রদায় নেই বলে হাতে কাঠ কাটতে সময় ও খরচ বেশি। তাই যেটা সহজ সেটাই বেছে নিচ্ছে মানুষ। তবে, হাত করাতি সম্প্রদায় আমাদের গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে। বাঙালী ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে এই সম্প্রদায়কে রক্ষা করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।

নুসরাত

×