ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১

অধিকাংশের গন্তব্য ইউরোপ

আগস্ট থেকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ বেড়েছে

প্রকাশিত: ১৫:৫৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৫:৫৫, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আগস্ট থেকে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ বেড়েছে

ছবি: সংগৃহিত

গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশি নাগরিকদের মধ্যে নাগরিকত্ব পরিত্যাগের প্রবণতা বেড়েছে, বিশেষত উচ্চবিত্ত শ্রেণির মধ্যে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষাসেবা বিভাগের অধীন বহিরাগমন অনুবিভাগের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যুত্থানের পরবর্তী চার মাসে নাগরিকত্ব পরিত্যাগের হার আগের চার মাসের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত বছরের এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাসে ৯৯ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছিলেন, তবে আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০৭ জনে। বিশেষত, আগস্টে ৩৬ জন, সেপ্টেম্বরে ২ জন, অক্টোবরে ১১২ জন এবং নভেম্বরে ৫৭ জন নাগরিকত্ব ছেড়েছেন।

নাগরিকত্ব পরিত্যাগকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের নতুন নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। জার্মানি এই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে, যেখানে ১৩২ জন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করে জার্মান নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছেন। এছাড়া, ৪৫ জন অস্ট্রিয়ার, ১৪ জন হংকংয়ের, ৪ জন সিঙ্গাপুরের এবং ২ জন ভারতের নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

বিশ্লেষকদের মতে, নাগরিকত্ব ত্যাগের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে। কেউ কেউ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশ ছাড়ছেন, আবার অনেকে বিদেশে একক নাগরিকত্বের সুবিধা নিতে চাইছেন। বিশেষত, অভ্যুত্থানের পর বিচার এড়াতে অনেক বিত্তবান নাগরিক ও বিগত সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু অলিগার্করা নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নাগরিকত্ব পরিত্যাগের প্রক্রিয়া সাধারণত বাংলাদেশ দূতাবাসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়, যেখানে আবেদন যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সম্প্রতি আলোচিত কিছু ব্যবসায়ী ও শিল্পগোষ্ঠীর মালিকদের নাগরিকত্ব পরিত্যাগের খবর প্রকাশ পেয়েছে। সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুরে বসবাস করলেও তার নাগরিকত্ব ছিল বাংলাদেশের। তবে সিঙ্গাপুর দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন না দেওয়ায় তিনি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেশটির নাগরিক হয়েছেন।

এছাড়া, এস আলম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তাদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো একটি চিঠিতে জানানো হয় যে, ১৯৮০ সালের বিদেশি বিনিয়োগ আইনের অধীনে তারা সিঙ্গাপুরের নাগরিকত্ব পেয়েছেন এবং আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার হুমকিও দিয়েছেন।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, অনেকেই হয়তো আইনি জটিলতা এড়াতে নাগরিকত্ব ত্যাগ করেছেন। তিনি বলেন, "বিগত সরকারের আমলে অনেক অলিগার্ক দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান থাকায় তারা নাগরিকত্ব ত্যাগ করে বিচার থেকে রেহাই পেতে চাইতে পারেন।"

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীরের মতে, রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণেও অনেকেই বিদেশে স্থায়ী হওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, "বিশেষত ব্যবসায়ীদের জন্য বিদেশে অর্থ বিনিয়োগ এবং নাগরিকত্ব নেওয়া একধরনের ‘ট্রাম্প কার্ড’ হয়ে উঠেছে, যাতে তারা প্রয়োজন হলে দেশ ছাড়তে পারেন।"

বাংলাদেশ থেকে নাগরিকত্ব ত্যাগের হার বাড়লেও, বিদেশিরা তুলনামূলকভাবে কমসংখ্যায় বাংলাদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন। ১৯৮৮ সালে প্রথমবারের মতো ৪ জন বিদেশি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পান, যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেলেও এখন পর্যন্ত মাত্র ৪৫২ জন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই বৈবাহিক সূত্রে অথবা দীর্ঘদিন বসবাসের কারণে নাগরিকত্ব পেয়েছেন।

আইনজীবী শিশির মনির বলেন, "যদি কেউ অপরাধ সংঘটনের পর নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন, তবুও তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলতে পারে। তবে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশ থেকে অপরাধীদের ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যায়।"

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে দক্ষ কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। অন্যথায়, নাগরিকত্ব ত্যাগের প্রবণতা দুর্নীতিবাজদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করতে পারে।

ইসরাত জাহান

×