ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৪ মার্চ ২০২৫, ১৯ ফাল্গুন ১৪৩১

বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গলকামনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে

প্রকাশিত: ১৮:৩৬, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

বিশ্ব শান্তি ও মঙ্গলকামনার মধ্য দিয়ে  শেষ হলো এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা

টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে দুনিয়া ও আখেরাতের শান্তি লাভের আশায় মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে অশ্রুসিক্ত নয়নে দুই হাত তুলে লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের আমিন, আল্লাহুমা আমিন, ছুম্মা আমিন ধ্বনিতে মুখরিত দ্বিতীয় পর্বেও মাওলানা সাদপন্থিদের অংশ গ্রহণে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে রবিবার শেষ হয়েছে তাবলীগ জামাতের এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা। মোনাজাতে লাখো মুসল্লি নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নিজ নিজ গুনাহমাফের পাশাপাশি দুনিয়ার সব বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার জন্য কেঁদে বুক ভাসান। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি ও কামনা করা হয়। মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, অগ্রগতি, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়। ইজতেমার এ পর্বে মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারীরা অংশ নেন। 

বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী রবিবারের এ মোনাজাত পরিচালনা করেন। তিনি বেলা ১২টা ৩৭ মিনিট থেকে ১টা ৭ মিনিট পর্যন্ত প্রায় ৩০ মিনিট স্থায়ী মোনাজাত পবিত্র কোরআনে বর্ণিত দোয়ার আয়াত এবং উর্দু ভাষায় পরিচালনা করেন। তাৎপর্যপূর্ণ এই  আখেরি মোনাজাতে জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তি, আত্মশুদ্ধি ও নিজ নিজ গুনাহ মাফের জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে রহমত প্রার্থনা করা হয়। মোনাজাত শুরু হলে অগণিত মানুষের জনসমুদ্রে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে কিংবা বসে দু’ হাত তুলেন আল্লাহর দরবারে। মোবাইল ও স্যাটেলাইট টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের সুবাদে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মানুষ একসঙ্গে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরাসহ চারপাশের এলাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান, অফিসসহ সবকিছু ছিল বন্ধ। 

রবিবার আখেরী মোনাজাতে শরীক হতে সূর্যদোয়ের পুর্ব থেকে ধনী দরিদ্র যুবক বৃদ্ধ নির্বিশেষে লাখো মানুষ ইজতেমাস্থলের দিকে আসতে শুরু করেন। সকাল ৯টার আগেই ইজতেমা মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলি-গলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে অনেকে কামারপাড়া সড়ক ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভিন্নস্থানে অবস্থান নেন। রবিবার ভোর থেকেই ফজরের নামাজ ও আখেরি মোনাজাতের জন্য পুরানো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন সিট বিছিয়ে বসে পড়েন। এছাড়াও পাশ্ববর্তী বাসা-বাড়ি-কলকারখানা-অফিস- দোকানের ছাদে, যানবাহনের ছাদে ও তুরাগ নদীতে নৌকায়  মুসল্লিরা অবস্থান নেন। যে দিকেই চোখ যায় সে দিকেই দেখা যায় শুধু টুপি-পাঞ্জাবি পড়া মানুষ। সবাই অপেক্ষায় আছেন কখন শুরু হবে সেই কাঙ্খিত আখেরি মোনাজাত। আখেরি মোনাজাতের জন্য রবিবার আশপাশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। কোন কোন প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘোষণা না করলেও কর্মকর্তাদের মোনাজাতে অংশ নিতে বাধা ছিল না। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ এমনকি মহিলারাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে রবিবার সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছেন। আবার অনেকে ইজতেমা ময়দানে আসতে না পেরে মোবাইল ফোনে দূর-দূরান্ত থেকেও মোনাজাতে শরিক হন। 

এবার আখেরি মোনাজাত নির্বিঘ্ন করতে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মুসল্লিদের যাতায়তের সুবিধার্থে রেলওয়ে বিভাগ ৮টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। ইজতেমার এ পর্বে বিশ্বের ৬৪টি দেশের প্রায় ১৬’শ বিদেশি মেহমান অংশ গ্রহণ করেন। আখেরি মোনাজাত শেষে তারা দাওয়াতি সফরে দেশ বিদেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়বেন। 

যারা বয়ান করলেন 
এবারের বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের শেষদিন রবিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) ফজরের পর বয়ান করেন দিল্লি নিজামউদ্দিনের মাওলানা মোরসালিন। তার বয়ান বাংলায় তরজমা করেন মুফতি আজিম উদ্দিন। তার বয়ানের পর মোনাজাতের আগ পর্যন্ত চলে হেদায়তি বয়ান। রবিবার সকাল সাড়ে ৯টার পর থেকে আখেরি মোনাজাতের আগ পর্যন্ত তাবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে দিক নির্দেশনা মূলক হেদায়েতি (দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি) বয়ান করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরব্বি ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীর বড় ছেলে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী। এসময় তার বয়ানের বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা মুনির বিন ইউসুফ। হেদায়েতি বয়ান শেষে আখেরী মোনাজাত পরিচালনা করেন মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ। 

বয়ানে যা বলা হয়েছে 
বয়ানে মাওলানা মোরসালিন বলেন, আল্লাহর গজবের বড় স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। তিনি আল্লাহর রাস্তায় তাবলীগে দাওয়াতি কাজে পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার পরামর্শ দেন। কারণ পায়ে হেঁটে বেশি মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হবে। এতে পায়ে যে ধূলাবালি লাগবে তা জাহান্নামের আগুনকে ঠান্ডা করে দেয়। তিনি তাবলিগের দাওয়াতি কাজে গিয়ে মানুষের কাছে ইহজগতের জন্য ছওয়াল করতে বারণ করে বলেন, যে জামাত ছওয়াল করে আল্লাহর সাহায্যের দরজা তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। ছওয়াল করলে দিলে শয়তান স্থান পায়। দাওয়াতি কাজে সবচেয়ে বড় কাজ হলো নিজের নিয়তকে সহি করা এবং অন্যের কাছে ছওয়াল না করা।  

হেদায়েতি বয়ানে মাওলানা ইউসুফ বিন সাদ কান্ধলভী বলেন, যে ব্যক্তি দ্বীন ইসলামের বিধান আনুসারে চলবে এবং হযরত মোহাম্মদ (সাং) এর জীবনাদর্শ অনুসরন করবে, সে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব অর্জন করবে। নামাজের আগে আমাদের দিলে এক্বিন বা ঈমান পয়দা করতে হবে। তা না হলে নামাজের ফজিলত পাওয়া যাবেনা। 

বিদেশীদের অংশগ্রহণ
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের (নিজামুদ্দিন মারকাজের) মিডিয়া সমন্বয়কারী মোহাম্মদ সায়েম জানান, ৬৪টি দেশের ১হাজার ৫৮৪ জন মুসল্লি যোগ দিয়েছেন। এর মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, ইরাক, ইরান, লিবিয়া, জর্ডান, আরব আমিরাত, ইথুয়িপিয়া, আফ্রিকা, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ইত্যাদি দেশ থেকে ওই মুসল্লিরা অংশ নেন। 

দেড় সহস্রাধিক জামাত তৈরি 
বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটির মিডিয়া সমন্বয়ক মোহাম্মদ সায়েম জানান, বিভিন্ন দেশে তাবলীগের কাজে বের হতে এবার ইজতেমা স্থলে দ্বিতীয় পর্বে দেড় সহস্রাধিক জামাত তৈরি হয়েছে। এসব জামাতে কেউ কেউ ১০/১৫ দিনের, এক চিল্লা, দু’চিল্লা, তিন চিল্লা, ৫ চিল্লা ও একবছরের চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামি ১৫-২০ দিনের মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।

মোনাজাত শেষে যানজট ও যানজট 
আখেরি মোনাজাত শেষ হওয়ার পরপরই বিভিন্ন স্থান থেকে আশা মানুষ নিজ গন্তব্যে পৌঁছার চেষ্টা করে। আগে যাওয়ার জন্য মুসল্লি¬রা তাড়াহুড়া শুরু করে। এতে টঙ্গীর কামারপাড়া সড়ক, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী- কালীগঞ্জ সড়কের আহসান উল্লাহ মাষ্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের সড়ক-মহাসড়ক এবং সংযোগ সড়ক গুলোতে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ জনজট ও যানজট।  

 

রাজু

×