
পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার
পিলখানায় বিডিআর হত্যাকাণ্ড ছিল বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদী শক্তির দখলদারিত্ব কায়েম করা ও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলে মন্তব্য করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, পিলখানা হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ডদের অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
শনিবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনে (বিএফডিসি) বাংলাদেশ রাইফেলসে (বিডিআর) হত্যাকা- নিয়ে আয়োজিত ছায়া সংসদে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষকে জিম্মি করার জন্য, ভোটের অধিকার হরণ করার জন্য, নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করার জন্য বিডিআর হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটানো হয়েছিল।’ ‘সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদের প্রচ্ছন্ন নিষ্ক্রিয়তা ছাড়া বিডিআর হত্যাকা- সম্ভব ছিল না। এ হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ডদের বের করতে হবে।’
ভারতের সমালোচনা করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘একটি বন্ধু রাষ্ট্র বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার নামে বাংলাদেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। এখন একজন খুনিকে আশ্রয় দিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।’
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে আমরা জাতির সূর্য সন্তানদের হারিয়েছি। তাদের হারানোর মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ভিতকে আঘাত করা হয়েছে। ৫৭ সেনাকর্মকর্তাকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের কবর রচনা করে নৈরাজ্যবাদের জন্ম দিয়েছিল পতিত আওয়ামী সরকার।
ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের বিডিআরের পোশাক পরে পিলখানা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। পিলখানা হত্যাকা-ের মাস্টারমাইন্ডদের অনেকেই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের বিচারের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ওপর আধিপত্যবাদী শক্তির দখলদারিত্ব কায়েমের জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশই ছিল পিলখানা হত্যাকাণ্ড। এটি কোনো বিদ্রোহ ছিল না, ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
এর মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে দেশকে চোরাবালির সন্ধিক্ষণে দাঁড় করানো হয়েছিল। একটি রাষ্ট্র বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বাংলাদেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছিল। আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে খুন-গুমে জড়িত ব্যক্তিকে আশ্রয় দিয়ে সেই রাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে।
সভাপতির বক্তব্যে ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির চেয়ারম্যান হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুই মাসের মাথায় ঢাকার পিলখানায় দেশের ইতিহাসে কলঙ্কময় হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। যা ইতিহাসের এক কালো দাগ। দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর চরম আঘাত আনার লক্ষ্যে এই হত্যাকা- ঘটানো হয়েছিল।
কোনো দাবি আদায়ের লক্ষ্যে নয়, সেনাবাহিনী যাতে দুর্বল হয়ে যায়, বিডিআর নামে যাতে শক্তিশালী কোনো বাহিনী না থাকে তার জন্যই এই হত্যাকা-। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর মাধ্যমে পিলখানা হত্যাকা- বন্ধ করার সুযোগ থাকলেও ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এটাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার লোক দেখানো চেষ্টা করা হয়েছে।
দরবার হলের কাছে র্যাবের একটি প্যাট্রোল টিম থাকলেও বিদ্রোহ দমনে তাদের পিলখানায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমরা লজ্জিত, দুঃখিত সেই সব সন্তানদের প্রতি যারা পিলখানার নারকীয় হত্যাকা-ে তাদের বাবা-মা হারিয়েছেন, যারা স্বামী হারিয়েছেন। স্বজনহারা এসব পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দেওয়ার ভাষা আমাদের নেই। যেদিন এই হত্যাকা-ের সঠিক বিচার হবে সেদিন হয়তো স্বজনহারারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন।
পিলখানায় হত্যাকা-ের সঠিক বিচারের দাবিতে হাসান আহমেদ চৌধুরী কিরণ ১০ দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবিগুলো হলোÑ ১) বিডিআর হত্যাকা-ের তদন্তের স্বার্থে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের লক্ষ্যে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা অথবা তদন্ত টিম ভারতীয় সরকারের সহযোগিতা নিয়ে তিনি যে স্থানে অবস্থান করছেন সেখানে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদ করা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। ২) তৎকালীন যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মির্জা আজম, ফজলে নূর তাপস, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম, মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকসহ সন্দেহভাজনদের কার কি ভূমিকা ছিল তা উদঘাটন করা।
৩) শহীদ সেনা পরিবারের সদস্যদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ২৫ ফেব্রুয়ারিকে শোক দিবস হিসেবে ‘শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করা। ৪) বিডিআর হত্যাকা-ে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র ছিল কিনা তা অনুসন্ধান করা। ৫) তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ যেহেতু স্বপ্রণোদিত হয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিডিআর হত্যাকা- মোকাবিলায় সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি বলে অভিযোগ করেছেন।
অধিকতর তদন্তের স্বার্থে সাবেক সেনাপ্রধানকে বিডিআর হত্যাকা-ের ব্যাপারে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা। ৬) পিলখানা হত্যাকা- চলাকালে যারা বিডিআর সদর দপ্তরে সমবেত হয়ে সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘বিডিআর জনতা ভাই ভাই’ স্লোগান দিয়েছিল তাদের চিহ্নিত করা।
৭) বিডিআর হত্যাকা-ে নিহত, আহত সামরিক/বেসামরিক ব্যক্তিদের বিডিআর সদর দপ্তরের সামনে তাদের নামফলক দৃশ্যমানভাবে উল্লেখ করা ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া। ৮) সেনাকুঞ্জে যেসব সেনাকর্মকর্তারা এ হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার কারণে চাকরি হারিয়েছিলেন তাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা, একই সঙ্গে বিডিআরের যেসব সদস্য পিলখানার হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তাদেরও চাকরিতে পুনর্বহাল করা।
৯) পিলখানা হত্যাকা-ের প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন ও প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার দেওয়া। ১০) বর্তমান প্রজন্মের কাছে পিলখানার নির্মম হত্যাকা-ের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার জন্য পাঠ্যপুস্তকে প্রকৃত ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করা।
ডিবেট ফর ডেমোক্রেসির আয়োজনে ‘ক্ষমতায় টিকে থাকতে আওয়ামী লীগ সরকার বিডিআর হত্যাকা- ঘটিয়েছে’ শীর্ষক ছায়া সংসদে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বিতার্কিকদের পরাজিত করে তেজগাঁও কলেজের বিতার্কিকরা বিজয়ী হয়। প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন অধ্যাপক আবু মুহাম্মদ রইস, ড. এস এম মার্শেদ, ব্যারিস্টার এইচ এম সানজিদ সিদ্দিক, মনিরুজ্জামান মিশন ও মো. আতিকুর রহমান। প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী দলকে ট্রফি, ক্রেস্ট ও সনদপত্র দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য , ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি বিডিআর সদরদপ্তরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন। দেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোড়ন তোলে ওই ঘটনা। এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুইটি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে মুক্তি আটকে আছে ৪৬৮ বিডিআর সদস্যের।
হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ৮৫০ জনের বিচার কাজ শেষ হয়েছে। এতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদ- বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে এবং বিভিন্ন মেয়াদে ২২৮ জনকে সাজা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ২৮৩ জনকে খালাস দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের রায়ের পূর্বে ১৫ জনসহ মোট ৫৪ আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টে ৮৩ আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়।
অন্যদিকে বিস্ফোরক আইনের মামলায় ২০১০ সালে ৮৩৪ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ফলে এ মামলার বিচার ঝুলে যায়। তবে শাসন ক্ষমতার পরিবর্তনে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি উঠে।