ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১ ফাল্গুন ১৪৩১

আয়না ঘর: ন্যায়বিচারের পথে বাংলাদেশ কি সাহসী হবে?

ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম   চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী গবেষণা কেন্দ্র  

প্রকাশিত: ১২:২৪, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আয়না ঘর: ন্যায়বিচারের পথে বাংলাদেশ কি সাহসী হবে?

ছবিঃ সংগৃহীত

বাংলাদেশের ইতিহাসে নিপীড়নের অনেক অধ্যায় আছে, কিন্তু আয়না ঘরের বাস্তবতা যেন তার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। এটি কোনো সাধারণ বন্দিশালা নয়—এটি রাষ্ট্রক্ষমতার নিষ্ঠুরতম দিকের সাক্ষী, যেখানে মানুষ হারিয়ে গেছে, নিখোঁজদের স্মৃতিগুলো কেবল দেয়ালে আঁকা অস্পষ্ট বাক্যে বেঁচে আছে।  

প্রশ্ন একটাই—এখন কী হবে? এই সত্য প্রকাশের পর, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা কি সম্ভব হবে?  

 অবশেষে উন্মোচিত নিষ্ঠুরতা  

আয়না ঘর সম্পর্কে এতদিন যা শোনা গেছে, তা ছিল ফিসফাস বা ভুক্তভোগীদের বিচ্ছিন্ন স্বীকারোক্তি। কিন্তু এবার প্রমাণ হাতে এসেছে—মাছের কাঁটায় খোদাই করা হতাশার বাণী, নির্যাতনের চিহ্ন, ইলেকট্রিক রিভলভিং চেয়ার, বন্দি নির্যাতনের কৌশল—এসব কোনো গল্প নয়, বাস্তব। গুম কমিশনের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, কীভাবে ডিজিএফআই ও সেনাবাহিনীর বিশেষ শাখা এখানে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বা চক্রান্তের অভিযোগে মানুষকে আটকে রাখত। এখানে দিনের পর দিন মানুষ নিখোঁজ থেকেছে, অনেকে জীবিত ফেরেনি।  

আমরা জেনেছি, সেখানে নির্যাতনের জন্য আলাদা ঘর ছিল। ওয়াশরুমে ফুটো করা ছিল, যাতে বন্দিদের ওপর নজর রাখা যায়। ছোট্ট কুঠুরির ভেতরে দীর্ঘদিন আটকে রেখে মানুষকে পঙ্গু করে দেওয়া হতো। এমনকি নির্যাতনের ধরণ বদলে দিতে রুমের কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে—নতুন রং, নতুন দরজা, নতুন টাইলস। যেন অতীতের সব চিহ্ন মুছে ফেলা যায়। কিন্তু সত্যকে কি মুছে ফেলা যায়?  

 বিচার কি সম্ভব?  

আয়না ঘর খোলার পরপরই প্রতিরক্ষা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেদোয়ানের মতো ব্যক্তিরা এখনো চাকরিতে বহাল আছেন। গুম কমিশন যে সামরিক কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করেছে, তাদের একজনও বিচারের মুখোমুখি হননি।  

তাসনিম খালিল ও অন্যান্য সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে এসেছে, কীভাবে প্রসিকিউশনের চলমান তদন্তকেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এমনকি উত্তরা র‌্যাব অফিস পরিদর্শনের সময় এক লাইভ বোমা ডিফিউজ করতে হয়েছে—এর অর্থ কী? তদন্তকারীদের টার্গেট করা হচ্ছে?  

এরকম পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচার সম্ভব কি?  

 *ওয়াকার সাহেব, আপনি কী করবেন?*  

এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। ওয়াকার-উজ-জামান সাহেব, আপনার সামনে দুটি পথ—আপনি আপনার বাহিনীকে রক্ষা করবেন, নাকি ন্যায়ের পক্ষ নেবেন?  

আমরা জানি, আপনার ওপর চাপ আছে। হয়তো ভেতরে থেকেই আপনাকে সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস আপনাকে কীভাবে মনে রাখবে, সেটাই এখন গুরুত্বপূর্ণ।  

আপনার সামনে উদাহরণ আছে। পাকিস্তানের জেনারেলরা যখন একাত্তরে গণহত্যা চালিয়েছিল, তখন কেউ কেউ তাদের অপরাধ ঢাকতে ব্যস্ত ছিলেন, আবার কেউ কেউ নীরবে সহায়তা করেছিলেন। আপনি কোন পথে যাবেন?  

আপনার বাহিনীর কিছু সদস্য নিরীহ মানুষদের ওপর যে অত্যাচার চালিয়েছে, তা কি আপনি অস্বীকার করতে পারবেন?  

আপনাকে বলছি—একজন বাবার চোখ দিয়ে দেখুন। ভাবুন, যদি আরমানের মেয়ে বা ইলিয়াস আলীর সন্তান আপনার সন্তান হতো? যদি একদিন আপনার সন্তান জানতে পারত, আপনি বিচার না করে অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন?  

আপনি কি নিশ্চিত যে আজ যারা অপরাধ করেছে, তারা ভবিষ্যতে আপনার বিরুদ্ধে যাবে না?  

আমাদের প্রজন্মের কাছে দায়বদ্ধতা 

বাংলাদেশের মানুষ বিচার চায়। গুম হওয়া মানুষদের সন্তানরা বড় হচ্ছে—তারা একদিন প্রশ্ন করবে, কেন তাদের বাবাদের গুম করা হলো, কেন তাদের প্রিয়জনরা ফিরে এল না?  

এখন সময়—সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর। প্রসিকিউশান টিম যেন সব প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে, সব অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হয়, সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব আপনার।  

আপনার অফিসে ইলিয়াস আলীর মেয়ের ছবি টাঙান। মনে রাখুন, শেখ হাসিনা একদিন তার মাথায় হাত রেখেছিলেন, কিন্তু জানতেন তিনিই তার বাবাকে গুম করিয়েছেন। ইতিহাস যেন আপনাকে এমন এক ব্যক্তির তালিকায় না ফেলে, যিনি অন্যায় ঢাকার জন্য দায়ী।  

আমরা ন্যায়বিচার চাই। আপনি কি তা নিশ্চিত করতে পারবেন?

জাফরান

×