![বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল বগুড়ার ঐতিহ্যবাহী জামাই মেলায় মানুষের ঢল](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/p12-2502121848.jpg)
দোকানের সবচেয়ে বড় কাতলা মাছটি দেখিয়ে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছেন বিক্রেতা সাহেব আলি
উৎসবের সুরের ভেলায় পুরো এলাকাজুড়ে মানুষের ঢল। নানা শ্রেণি পেশা ও ধর্ম-বর্ণের মানুষের ¯্রােত এক অমোঘ আকর্ষণে ছুটে চলে নির্দিষ্ট বিন্দুর দিকে। এ যেন এক প্রতিযোগিতা। মেলবন্ধনের লোকজ ঐতিহ্যের চিরায়ত রূপ মেলে ধরে মানুষের এই স্রোত মিলছিল এক প্রাচীন মেলা প্রঙ্গণে।
এমনি সম্প্রীতির বন্ধন আর সর্বজনীন উৎসবমুখরতায় বুধবার বগুড়ায় হয়ে গেল এ অঞ্চলের সর্ববৃহৎ প্রাচীন পোড়াদহ সন্ন্যাসী মেলা। এই ইন্টারনেটের যুগে অনেকের কাছে এটি আবার জামাই মেলা হিসেবেও পরিচিত। মাছের মেলা হিসেবেই এর পরিচিত বেশি। মেলা প্রাঙ্গণ থাকে রকমারি মাছে ভরপুর।
৪শ’ বছরেরও বেশি পুরনো এই মেলায় এবার আকর্ষণ ছিল ৩৫ কেজি ওজনের বৃহৎ আকারের মাছ ও ১৫ কেজি ওজনের মাছের আকৃতিতে তৈরি করা বড় বড় মিষ্টি। ছিল মেলার অন্যসব অনুষঙ্গও। অনেকের মতে এই মেলা ৪শ’ বছরের বেশি পুরাতন। সন্ন্যাস বা পোড়াদহ মেলা হলেও এটি হালে জামাই মেলা হিসাবেও পরিচিত হওয়ার কারণ আশপাশের ২ শতাধিক গ্রামের জামাইসহ কুটুমরা এই মেলায় আসেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে।
মেলা থেকে জামাইরা বড় মাছ কিনে ঝুলিয়ে নিয়ে যান শ^শুরবাড়ি। সঙ্গে মিষ্টিসহ অন্যান্য কেনাকাটা। মেলা ঘিরে এলাকায় জামাইদের কদর অন্যরকম। কাঠের সামগ্রী থেকে আসবাবপত্র ও সাজসজ্জার পণ্য, তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে মেলা প্রাঙ্গণ থাকে ভরপুর। মুল মেলার পরেরদিন বসে নারীদের জন্য বউমেলা। যেখানে পুরুষদের প্রবেশেধিকার থাকে না। এখন এই বউ মেলার প্রচারও কম নয়।
ঐতিহ্যবাহী এই মেলা বগুড়া শহর থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে গাবতলি উপজেলার মহিষাবান ইউনিয়নের ইছামতি নদীর তীরে পোড়াদহ এলাকায়। রীতি অনুযায়ী প্রতিবছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার অথবা ফাল্গুন শুরুর প্রথম বুধবারে সন্নাসী বা পোড়াদহ মেলা বসে। তবে এবার মেলা হয়েছে মাঘের শেষ বুধবারে। প্রাচীন এই মেলার শুরুর সময় নিয়ে নানা ভিন্নতা থাকলেও এটির গোড়া পত্তন হয়েছিল পোড়াদহের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ইছামতি নদীর ধারে বটগাছকে ঘিরে। সেখানে এক সময় সন্ন্যাসীরা ধ্যান করতেন।
সন্ন্যাসী মেলা পূজা কমিটি জানিয়েছে, সারা ভারতবর্ষ থেকে ওই সময় সন্ন্যাসীরা আসতেন। সন্ন্যাসীদের আরাধনার যুগ শেষ হলেও তাদের ভক্তরা এক সময় সন্ন্যাস পূজা শুরু করেন। আর এই সন্ন্যাসী পূজা থেকেই পাশের এলাকাজুড়ে শুরু হয় মেলা।
পূজার পরের দিন বসে মেলা। সন্ন্যাসীদের ধ্যানের স্থানে পুরনো সেই বটগাছ না থাকলেও এখন নতুন করে জোড়া বটগাছ হয়েছে। এটিও অনেক প্রাচীন। এই বটগাছের নিচেই চলে সন্নাসী পূজা। পাশে মেলা প্রাঙ্গণ। যেখানে সব ধর্মের মানুষের পদচারণা।
পোড়াদহ সন্ন্যাসী মেলা পূজা কমিটির দাবি, মেলা প্রায় সাড়ে ৪শ’ বছরের পুরনো। মেলার আয়োজকরাও বলছেন এটি প্রায় ৪শ’ বছরের পুরনো। তবে মেলা কত প্রাচীন তা নিয়ে কথা থাকলেও মেলার জৌলুস দিন দিন বাড়ছে। সন্ন্যাসী পূজাকে কেন্দ্র করে মেলা শুরু হলেও এখন তা রূপ নিয়েছে সর্বজনীনতায়। ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবশ্রেণির মানুষের মিলনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এই মেলা।
নাগরদোলা থেকে শুরু করে খেলনা, কাঠের আসবার থেকে চুরি ফিতার দোকান। ঐতিহ্যবাহী মাছের বাজার থেকে শুরু করে নানা মিষ্টান্নের পসরা, বিভিন্ন ধরনের খাবারের দোকান, মাংসের জন্য পৃথক স্থান, চরকি থেকে নাগরদোলা কি নেই মেলায়। তবে মাছের পরেই এই মেলার কিন্তু প্রধান আকর্ষণ মাছ আকৃতির বড় বড় মিষ্টি।
অবিশ^াস্য মনে হলেও এক একটি মাছ আকারের মিষ্টির ওজন ৫শ’ গ্রাম থেকে ১৫-১৬ কেজি পর্যন্ত। মিষ্টির কারিগররা বিশেষ কায়দায় এ ধরনের বড় মাছ আকৃতির মিষ্টি তৈরি করে থাকেন। নানা বাহারি নামের লোভনীয় সব মিষ্টি চেখে না দেখে ফিরে আসা দায়।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেলার পরিচালক আমিনুল ইসলাম জানান, এই মেলার প্রধান আকর্ষণ মাছ হলেও সবই রয়েছে মেলায়। জামাইরা মেলা থেকে মাছ কিনবেন এটাই রীতি। কেউ ঈদে মেয়ে জামাইকে দাওয়াত না করলেও মেলায় দাওয়াত করতেই হবে, এটাই এলাকার রীতি। জামাইকে শ^শুরবাড়ির পক্ষ থেকে পড়বি দিতে হবে আর সেই টাকায় জামাই মাছ কিনবেন।