ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

জরিপ চলবে ডিসেম্বর পর্যন্ত

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে চীন

তাহমিন হক ববী, তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া থেকে

প্রকাশিত: ০০:০৬, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে চীন

তিস্তা ব্যারাজের উজানে নদীতে পানি স্বল্পতায় অসংখ্য চর পড়েছে

তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। যা উত্তরাঞ্চলের তিস্তাপাড়ের মানুষের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এর ভাঙন, ঢেউ আর চরের সঙ্গে যেন এসব মানুষের অবিচ্ছেদ্য স¤পর্ক। তিস্তা যেন নদীপাড়ের মানুষজনের সুখ-দুঃখের সাথী। তাই তিস্তার উন্নয়নে তিস্তাপাড়ের মানুষজনের দাবির দিকে তাকিয়ে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে জোর দিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার।

এজন্য চীনের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। তবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অন্তর্বর্তী সরকার তিস্তাপাড়ের মানুষজনের মতামতকে সামনে রেখে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায়। এ কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেতৃত্বে চীনের চায়না পাওয়ারের বিশেষজ্ঞ ও তিস্তাপাড়ের মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা শুরু করা হবে। জরিপ শেষে চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিবেদন জমা হবার পর চূড়ান্ত করা হবে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কাজ।

বিষয়টি ঠিক এভাবে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিস্তাপাড়ের মানুষজন বলছেন, দ্রুততার সঙ্গে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারলে তিস্তা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময় লাগবে না। এজন্য নজরদারি বাড়াতে হবে। 
সোমবার তিস্তাপাড়ে সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী, যা বাংলাদেশ এবং ভারত দুইটি দেশেরই অংশ। এটি ভারতের সিকিম থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট  দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলা দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

পরে তা পদ্মা ও মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। তিস্তার অববাহিকা আনুমানিক ১২ হাজার ১৫৯ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত। এ নদীটি বাংলাদেশ ও ভারতের তিন কোটির বেশি মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ তিস্তার ওপর নির্ভরশীল ৭০ ভাগ লোক বাংলাদেশে তিস্তার অববাহিকায় বসবাস করে। 
তিস্তা বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী। তিস্তার প্লাবনভূমি ২ হাজার ৭৫০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তীর্ণ। লাখো মানুষ কৃষি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা এবং গৃহস্থালি দৈনন্দিন পানির চাহিদা ও জীবিকা নির্বাহের জন্য তিস্তা নদীর ওপর নির্ভর করে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফসল বোরো ধান চাষের জন্য পানির প্রাথমিক উৎস এবং মোট ফসলি জমির প্রায় ১৪ শতাংশ সেচ প্রদান করে। তিস্তা ব্যারাজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেচ প্রকল্প।

এটি উত্তরাঞ্চলের নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার ডালিয়া ও লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলার দোয়ানী সীমানা এলাকায় অবস্থিত। এই প্রকল্পটির অন্তর্ভুক্ত উত্তরাঞ্চলের ছয়টি  নীলফামারী, রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট এবং বগুড়ার ধুনট পর্যন্ত এর কমান্ড এরিয়া (আওতাভুক্ত এলাকা)। যা ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর বিস্তৃত। এতেই বোঝা যায় তিস্তার সেচ ও তিস্তা নদী বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

জানা গেছে, তিস্তা নদীতে ভারতের উজানে পশ্চিমবঙ্গ এবং সিকিমে বাঁধ, ব্যারাজ, জলবিদ্যুৎসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে তিস্তা নদীর পানির প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই অবকাঠামোগুলো তিস্তার উজানে পানির চাহিদা পূরণ করছে। কিন্তু তা ভাঁটিতে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা নদীতে পানির প্রাপ্যতা দারুণভাবে হ্রাস করেছে। 
সূত্র মতে, বিগত শেখ হাসিনা সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রকল্পে বিনিয়োগে চীনের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছিল। কিন্তু তারা সেটি বাস্তবায়ন করেননি। তাই চীনের সঙ্গে করা সেই সমঝোতা স্বাক্ষরের সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার এটি নিয়ে নতুন করে মাঠে নেমেছে। যা পরিষ্কার করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিস¤পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।

তিনি রবিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা সড়ক সেতুর পাশে তিস্তা নিয়ে করণীয় শীর্ষক গণশুনানিতে অংশ নিয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চীনকে দুই বছরের সময় দিতে সম্মত হয়েছি আমরা দুইটি শর্তে। এখানে দুইটি ব্যাপার আছে- এক. তিস্তার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে আমাদের পানিবণ্টন।

এটা আমাদের মন্ত্রণালয় থেকে আমরা ভারতকে বারবার বলব, তিস্তায় যদি বানের পানি আসে, এ নদীটার প্রকৃতিতে এমন হঠাৎ করে পানি চলে আসে। কিন্তু আমাদের যদি সময়মতো জানানো হয়, তাহলে তো আমরা ক্ষয়ক্ষতিটা কমাতে পারি। তিনি  বলেন, একদিকে আমাদের চুক্তি, আরেকদিকে আমাদের যেন সময়মতো জানানো হয়।

ভারত গেট খোলার আগে কয়েক ঘণ্টা সময় দিলে অনেক মানুষকে সরিয়ে নিতে পারি। গরু-ছাগলগুলো সরিয়ে নিতে পারি। ভারতের তো এটা আমাদের না জানানোর কোনো কারণ নেই। তাহলে কেমন ভালো বন্ধু, কেমন প্রতিবেশী? একটা বন্ধুত্বের পরিচয় হবে কাজ দিয়ে। এটা আমাদের দাবি থাকতে হবে। 
উপদেষ্টা বলেন, ২০১৬ সালে চুক্তিটা স্বাক্ষর হয়েছিল মহাপরিকল্পনার জন্য। সেই চুক্তি অনুযায়ী চীন কিন্তু একটা প্রকল্প দিয়েছে। মহাপরিকল্পনা দিয়েছে। ওইটা যখন আবার চায়না সরকারকে পাঠানো হয়, তারা দেখল যেভাবে প্রস্তাবনা করা হয়েছে, সেটি টেকসই হবে না। এখন চীন আবার আমাদের কাছে দুই বছর সময় চাচ্ছে। আমরা তাদের দুই বছর সময় দিতে রাজি হয়েছি। কিন্তু দুইটি শর্তে।

একটা হলো কি থাকবে আর কি থাকবে না। এটার ব্যাপারে তিস্তা পাড়ের মানুষের মতামত শুনতে হবে। ওইটা শোনার জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড ও চীনের চায়না পাওয়ার যৌথভাবে তিস্তাপাড়ে বসবাসরত মানুষজন, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে জরিপ পরিচালনা করবে। এতে প্রাধান্য দিতে হবে তিস্তাপাড়ের মানুষজনের মতামতকে। এই জরিপের মতামতের পরিকল্পনাটা ২০২৫ এর ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত করতে হবে। যা তিস্তাপাড়ের মানুষজনের  মতামত ছাড়া মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে না। 
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন, তিস্তা নদীর ৪৫ কিলোমিটারের ভাঙনের মধ্যে ২০ কিলোমিটারে বেশি ভাঙন হয়। আমি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে  নির্দেশ দিয়েছি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে পুরো এলাকাটা একটি টেন্ডার করবে। এবং এ সপ্তাহের মধ্যে তৈরি করবে। এটা আগে একটা পরিকল্পনা করতে হয় একটা ডিজাইন করতে হয়।

অনেক লম্বা সময় ধরে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় হয়ে সেটি পাস হয়। আমরা সেদিকে যাব না। আমরা একটা টেন্ডার কল করে মার্চ মাসের মাঝামাঝি তিস্তা নদীর ভাঙন রোধের কাজ শুরু করে দেব। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবকিছু আমাদের হাতে নেই। শুধু ভারত বা অন্য দেশে না, আন্তর্জাতিক মহলেও চেষ্টা করব।

×