ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৯ মাঘ ১৪৩১

নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষকদের শাহবাগে অবরোধ

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষকদের শাহবাগে অবরোধ

আন্দোলনকারী সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের লাঠিচার্জ, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ব্যবহার করে ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ

সুপারিশপ্রাপ্ত প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক-২০২৩ (৩য় ধাপ) ও ১ থেকে ১২তম বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসি) নিবন্ধিত নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষকরা শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন। মঙ্গলবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তারা।

প্রথমে ব্যাপক লাঠিচার্জ, দফায় দফায় জলকামান, আটক, টিয়ারগ্যাসেও সড়ক থেকে সরানো যায়নি তাদের। ফলে, দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যায় শাহবাগ থেকে সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত সড়কের উভয় পাশের যান চলাচল। একপর্যায়ে বিকেল পৌনে ৪টার পরে ফের বলপ্রয়োগ শুরু করে পুলিশ। সবশেষ কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এরপর যান চলাচল শুরু হয়।

লাঠিচার্জে চারজন আহত হয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ কয়েকজনকে আটক করেছে। ৩ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি বন্ধ থাকায় শাহবাগ ও আশপাশের রাস্তায় যানচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে তীব্র যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। 
দুপুর ১টার পরপরই শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন ১২তম এনটিআরসি নিবন্ধিত নিয়োগ প্রত্যাশীরা ও সুপারিশপ্রাপ্ত প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকরা। পুলিশ লাঠিপেটা আর জলকামান নিক্ষেপের পর প্রথম থেকে ১২তম এনটিআরসি নিবন্ধিত নিয়োগ প্রত্যাশীরা শাহবাগ মোড় ত্যাগ করেন। তবে অবস্থান নেওয়া সুপারিশপ্রাপ্ত প্রাথমিক সহকারী শিক্ষকদের পুলিশ বুঝিয়ে সড়ক ছাড়ার কথা বললেও তারা তাতে কান দেননি। দাবি মেনে নেওয়া না পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। 
পরে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ, দফায় দফায় জলকামান ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। আটক করে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় কয়েকজনকে। এতেও সড়ক থেকে সরানো যায়নি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সুপারিশপ্রাপ্ত (৩য় ধাপ) শিক্ষকদের। এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে লাঠিচার্জ, জলকামান এবং বলপ্রয়োগ করেও আন্দোলনকারীদের দমাতে না পেরে সর্বশেষ ৩টার দিকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করা হয়।

এ সময় আন্দোলনকারীদের ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘পুলিশের হামলা কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না, যাবে না’, ‘আমার ভাই আহত কেন, প্রশাসন জবাব চাই’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে দেখা গেছে। 
সরেজমিনে আরও দেখা যায়, কাঁদানে গ্যাসের ধোঁয়া উপেক্ষা করেই আন্দোলনকারীরা রাস্তায় বসে রয়েছেন এবং পরে পুলিশ সদস্যরা লাঠিচার্জ করে তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বিকেলে সরেজমিন দেখা গেছে, শাহবাগ মোড়ের অন্যান্য সড়ক থেকে এরই মধ্যে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। পরে অর্ধশতাধিক নারী আন্দোলনকারী জাদুঘরের পাশের সড়কের ওপর বসে পড়েন। এসময় বেশ কয়েক দফায় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। টেনেহিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয় কয়েকজনকে। পুলিশের উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে আহতও হন অনেকেই। 
চারজন আহত ॥ বিকেল ৪টার দিকে শাহবাগ থেকে আহত অবস্থায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসা হয়। আহতরা হলেন- প্রাথমিক শিক্ষক নাজমুন নাহার কনা (২৭), নিবন্ধিত শিক্ষক রিয়াজ উদ্দিন (৪২), পথচারী সীমা আক্তার (২৩) ও তানজিলা আক্তার (২৩)।
নাজমুন নাহার কনাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা প্রাথমিক শিক্ষক সুরাইয়া জানান, হাইকোর্ট আমাদের প্রাথমিক শিক্ষক নিবন্ধন চূড়ান্ত হওয়ার পরে হাইকোর্ট তা বাতিল করে। সেই বাতিলের বিরুদ্ধে আমরা শাহবাগের অবস্থান কর্মসূচি পালন করার সময় পুলিশ লাঠিচার্জ ও টিয়ারশেল মেরে আমাদের আহত করে।
নিবন্ধিত শিক্ষক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, আমরা নিবন্ধিত হলেও এখনো আমাদের কোনো স্কুলে নিয়োগ দেওয়া হয় নাই। নিয়োগের দাবিতে আমরা শাহবাগে অবস্থান করাকালীন পুলিশ আমাদের ওপরে লাঠিচার্জ করে। এতে আমি আহত হই।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, শাহবাগ থেকে আহত অবস্থায় ৪ জনকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের জরুরি বিভাগে চিকিৎসা চলছে। 
কয়েকজন আটক ॥ আন্দোলন থেকে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। তবে আটকের সংখ্যা জানা যায়নি। 
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মো. মাসুদ আলম এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আটকের সংখ্যা এখনই বলা যাচ্ছে না। আমরা আন্দোলনকারীদের নিয়ে থানায় রেখেছি। যাচাইবাছাই শেষে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হলে পরে জানানো হবে।
হিজাব পরে আন্দোলনে আসেন এক ব্যক্তি। তিনি দাবি আদায়ের স্লোগান দিতে থাকেন। পাশপাশি বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাবির বিষয় তুলে ধরেন। পরে ওই ব্যক্তিকে আটক করে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। এর আগে হিজাব পরে আন্দোলনে আসার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই ব্যক্তি বলেন, পুলিশ আমাদের দাঁড়াতে দিচ্ছে না। মারধর করে। তাই তিনি এভাবে আন্দোলনে এসেছেন। 
তীব্র যানজট, ভোগান্তি ॥ গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কটি অবরোধ করে রাখায় শাহবাগ ও আশপাশের রাস্তাও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দেখা দেয় তীব্র যানজট। ফলে, ভোগান্তিতে পড়েন বাসযাত্রী, সাধারণ মানুষ। 
দেখা যায়, আন্দোলনকারী শাহবাগ থেকে সায়েন্সল্যাবমুখী সড়ক অবরোধের ফলে এই সড়কের দুই পাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সায়েন্সল্যাব থেকে শাহবাগের দিকে আসতেই অনেক যানবাহন আটকা পড়ে যায়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার আশপাশের গলিতে ঢুকে যায়। তবে যাত্রীবাহী বাস ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে।

একটা পর্যায়ে পেছনের গাড়ি সরানো হয়। এরপর পেছনে গিয়ে কাঁটাবন, বাটা সিগন্যাল দিয়ে ডানে-বামে দিয়ে গন্তব্যে যেতে হয় যাত্রীবাহী বাস চালকদের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ও মৎস্যভবন থেকে আসা যানবাহন বাংলামোটরমুখী সড়ক দিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। এছাড়া শাহবাগ থেকে ফার্মগেটগামী সড়কে গাড়ি চলাচল করে।  
শাহবাগে গুরুত্বপূর্ণ দুটি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও স্বজনরা পড়েছেন চরম বিপাকে। তাদেরই একজন সুমন শেখ। তিনি তার অসুস্থ বাবাকে সিএনজিতে করে কেরানীগঞ্জ থেকে বছিলা হয়ে শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি) বৈকালিক ডাক্তার দেখাতে আসেন। তিনি সায়েন্সল্যাব সিগন্যালে এসে আটকা পড়েন। সিএনজি কোথাও যেতে পারছিল না। হেঁটে যে হাসপাতালে যাবেন, কিন্তু তার বাবা গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় হাঁটতেও পারছিল না। পরে বাবাকে কোলে করে হাসপাতালে নিয়ে যান। 
বিকেল সাড়ে ৪ টার পর থেকেই পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনকারী সুপারিশপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সড়ক থেকে সরিয়ে দিতে বল প্রয়োগ শুরু করেন। কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে আন্দোলনকারীরা সড়ক ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এর পরপরই ওই সড়কে যান চলাচল শুরু হয়। 
দাবি না মানলে শাহবাগেই থাকার ঘোষণা ॥ এদিকে দাবি আদায় না হলে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে লাগাতার অবস্থান করার ঘোষণা দিয়েছেন সুপারিশপ্রাপ্ত প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষক (৩য় ধাপ) এবং ১-১২তম এনটিআরসিএর নিবন্ধিত নিয়োগ প্রত্যাশী শিক্ষকরা। সন্ধ্যায় তারা এ ঘোষণা দেন।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলনের স্থান ত্যাগ করা হবে না। একই সঙ্গে ১ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তি, আন্দোলনে পুলিশি হামলায় আহতদের সুচিকিৎসা, অবৈধ রায় বাতিল করে দ্রুত নিয়োগ দিতে হবে। এসময় পুরুষ পুলিশ সদস্যরা মেয়েদের ওপর হামলা চালিয়েছে অভিযোগ তুলে নিন্দা জানান তারা।

×