![‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/100-2502081854.jpg)
.
তাহমিন হক ববী, তিস্তা অববাহিকার ডালিয়া থেকে ॥ উত্তরাঞ্চলের প্রাণের নদী তিস্তা। বর্ষাকালে ফুঁসে ওঠে। সে সময় প্রতিমিনিটে সাড়ে ৪ লাখ কিউসেক পানি তিস্তা ব্যারাজের জলকপাট দিয়ে প্রবাহিত হয়। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে পানি প্রবাহ থমকে যায়।
শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) তিস্তার পানি প্রবাহ দুই হাজার কিউসেকে নেমেছে। এর আগে ৩ হাজার কিউসেক ছিল। তিস্তাপাড়ের বাসিন্দারা বলছেন, দিন দিন পানি প্রবাহ কমছে। মাইলের পর মাইল চর পড়েছে। তবে পানি প্রবাহ কমলেও চরের জমিতে কৃষি সেক্টরে আবাদ বেড়েছে। বিশেষ করে ভুট্টা, গম, সরিষা, মিষ্টি কুমড়া, পেঁয়াজ, মরিচ, বাদামসহ বিভিন্ন ফসল উৎপাদন হচ্ছে।
চলতি মৌসুমে তিস্তার পানিতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে । এখন চলছে সেচনির্ভর বোরো ধানের চারা রোপণ। কিন্তু নদীর পানি প্রবাহ কম থাকায় রোটেশন করে সেচ প্রদান করতে হচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। তিস্তাপাড়ের কৃষকরা বলছেন, বিগত সময়ের চেয়ে এবার বোরো ধান চাষ কমতে পারে। বোরোর পরিবর্তে ভুট্টা চাষ ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষক আমিনুর রহমান জানালেন, ভুট্টা খেতে তিন-চারবার সেচ দিলেই হয়ে যায়। বোরো ধান উৎপাদনে সেচ অনেক বেশি লাগে। ফলে তিস্তা সেচ কমান্ড এলাকায় ধানের চেয়ে ভুট্টা চাষ বেড়েছে।
এদিকে তিস্তা নদী নিয়ে গণশুনানির আভাস দিয়েছিলেন যুব ও ক্রীড়া এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি গত বছরের (২০২৪) ২৫ ডিসেম্বর কম্বল বিতরণে এসে নীলফামারীর জলঢাকায় এক সমাবেশে এই আভাস দেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, তিস্তার পানি সমস্যা সমাধানে আগামী বছরের শুরুতে গণশুনানির আয়োজন করবে সরকার। জনগণের কাছে সমস্যা শুনে সেই অনুযায়ী সমাধান করা হবে।
ওই সমাবেশে আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব আর বর্ষা মৌসুমে তলিয়ে যাওয়া, এটা উত্তরবঙ্গের মানুষের দীর্ঘদিনের সমস্যা। এই সমস্যা নিরসনে আপনাদের একটি সুখবর দিয়ে যাই। পানিস¤পদ উপদেষ্টা ও আমরা সকলে মিলে আগামী বছরের শুরুর দিকে উত্তরবঙ্গে আসব এবং তিস্তার যে পানির সমস্যা এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কীভাবে হতে পারে তার জন্য গণশুনানির আয়োজন করা হবে। আমরা উত্তরবঙ্গের মানুষের কথা শুনব। তিস্তা নিয়ে আপনাদের কথা শুনে তার পরিপ্রেক্ষিতে বৃহৎ পরিসরে একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আমি আশাবাদী, আপনাদের এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার একটি সমাধান হবে। জলঢাকার ওই সমাবেশের দিন রাতে সচিবালয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উত্তরাঞ্চলে শীতবস্ত্র বিতরণ স্থগিত করে ঢাকা ফিরে যান। নতুন বছরের জানুয়ারি পার হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ চলছে। এখনো সেই গণশুনানির দিন ঘোষণা করা হয়নি।
অপরদিকে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও তিস্তা মেগা প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়নের দাবিতে ‘জাগো বাহে তিস্তা বাঁচাই’ স্লোগানে আগামী ১৭ ও ১৮ ফেব্রুয়ারি তিস্তা নদী তীরবর্তী অঞ্চলে ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার কর্মসূচির ডাক দিয়েছে তিস্তা নদী রক্ষা আন্দোলন কমিটি। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী, বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক স¤পাদক আসাদুল হাবিব দুলু।
এ ব্যাপারে তিনি বলেন, তিস্তা মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে নদীর দুই পাড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের লক্ষ্যে দু’দিন দু’রাত মোট ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা করেছি। এই আন্দোলনে নিজ নিজ উদ্যোগে যুক্ত থাকবেন তিস্তা তীরবর্তী ৫ জেলা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রামের সকল কৃষক, তিস্তার চরবাসী ও সাধারণ জনগণ।
তিনি আরও বলেন, ১৩০ কিলোমিটার নদী তীরবর্তী ১১টি পয়েন্টে লাগাতার এই কর্মসূচি চলবে। এ জন্য ওই ৫ জেলায় বিএনপি ও তার সকল সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এ জন্য চলছে গণসংযোগ। প্রতিটি জেলায় প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে । এই ৪৮ ঘণ্টার লাগাতার কর্মসূচিতে তিস্তাপাড়ে লাখ লাখ মানুষ অবস্থান নেবেন বলে আশাবাদী আয়োজকরা।
আসাদুল হাবিব দুলু বলেন, ঐতিহ্যবাহী তিস্তা নদীকে ঘিরে এ অঞ্চলের মানুষদের এক সময় ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, মুখে ছিল ভাওয়াইয়া গান। তিস্তাপাড়ের মানুষ আনন্দে দিন কাটাত। তিস্তা নদী উত্তরাঞ্চলবাসীর কাছে মায়ের মতো। সেই তিস্তা এখন শুকিয়ে মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। তিস্তা নদী এখন ধু ধু বালু চর। যার প্রধান কারণ, পার্শ্ববর্তী দেশ শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি আটকে রাখে আর বর্ষা মৌসুমে বিনা কারণে পানি ছেড়ে দেয়। এর ফলে বন্যার কবলে লাখ লাখ পরিবারের বাড়ি-ঘর তলিয়ে যায়, হাজার হাজার মানুষ ভাঙনের কবলে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি-ঘর ছাড়া হচ্ছে। তিস্তা এখন আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে তিস্তা মানুষের জীবন-জীবিকার একমাত্র ভরসা ছিল সেই তিস্তা এখন বর্ষাকালে অভিশাপ আর শুষ্ক মৌসুমে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, তিস্তার সুষ্ঠু পানি বণ্টন ও তিস্তা মহাপরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘদিন বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু বিগত সরকার তিস্তাপাড়ের মানুষের সঙ্গে শুধু প্রতারণাই করেনি,পরিহাসও করেছে। আমরা মাঝে মাঝেই শুনেছি তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। আমরা এটাও জানি আমাদের বন্ধু পার্শ্ববর্তী দেশ চীন এখানে অর্থায়ন করার জন্য
আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। একটি স্মারকও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কি কারণে সেটি আলোর মুখ দেখতে পায়নি জানি না। আমরা যতটুকু জানি সেই স্মারকের মেয়াদও উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। এ অঞ্চলের মানুষ আশায় বুক বেধেছিল, মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তাদের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য আর জীবন-জীবিকা ফিরে পাবে। এই অঞ্চলের মানুষের কর্মচাঞ্চল্যতা তৈরি হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। বর্তমানে তিস্তার দিকে তাকালে আমাদের সকলের বুক হাহাকার করে ওঠে।