![আন্ধারমানিকে নৌকাবাইচ আন্ধারমানিকে নৌকাবাইচ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/37-2502071512.jpg)
তারুণ্যের উৎসব উপলক্ষে আন্ধারমানিক নদীতে নৌকা বাইচ
হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সংস্করণ বাংলার নৌকাবাইচকে ঘিরে কলাপাড়া পৌরশহর ঘেঁষা আন্ধারমানিক নদী যেন প্রাণের অস্তিত্ব ফিরে পেয়েছিল। এককালের স্রোতস্বিনী এখন যৌবনহারা নদী ‘আন্ধারমানিক’ নৌকাবাইচকে ঘিরে কয়েক ঘণ্টার জন্য উত্তাল ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে পুরনো চেহারায় ফিরেছে। ৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটির হেলিপ্যাড মাঠ থেকে মাঝের খেয়া পর্যন্ত প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা নৌকাবাইচকে ঘিরে ছিল নতুন চেহারায়। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে নদীটি উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে। দুই পাড়ে হাজার হাজার মানুষের ভিড় ছিল লক্ষণীয়।
অত্যাধুনিক আভিজাত্যের ছাপ ও নক্সার মধ্য দিয়ে তৈরি করা ১২টি ‘বাছারি’ নৌকা এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের পক্ষে ১২টি নৌকা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। মাদারিপুরের কালকিনি ও গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থেকে নৌকাগুলো আনা হয়। শুক্রবার বিকেলে হেলিপ্যাড মাঠ থেকে এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার মো. রায়হান কাওছার। তিনি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। বিশেষ অতিথি ছিলেন, বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি মো. মঞ্জুর মোর্শেদ আলম, পটুয়াখালীর পুলিশ সুপার মো. আনোয়ার জাহিদ। সভাপতিত্ব করেন পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক আবু হাসানাত মোহাম্মদ আরেফীন। কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসন আয়োজিত এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে শুক্রবার দিনভর শহরটির আন্ধারমানিক নদী তীরে উৎসুক মানুষের ভিড় ছিল লক্ষণীয়। তাদের পদচারণায় গোটা মাঠ মুখরিত হয়ে ওঠে। ইউএনও মো. রবিউল ইসলাম জানান, তারুণ্যের উৎসব-২০২৫ উদযাপনের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ছিল নৌকাবাইচ।
বিকেল ঠিক ৩টার পরেই দুই ভাগে ৬টি করে ১২টি নৌকা আন্ধারমানিক নদীতে অবস্থান করে। কোনো নৌকায় ৫০ জন, আবার কোনো নৌকায় ৭০-৮০ জন মাল্লা বৈঠা হাতে একের পেছনে আরেকজন দুই সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা। প্রত্যেকটিতে কাশ, টিকারা, কাঁসর, বাঁশি আর ঝাঁজর হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন সহযোগীরা। মাইকে ঘোষণার সঙ্গেই বাঁশির হুইসেলে সমস্বরে হে-ইয়ো শব্দের ধ্বনিতে মুখরিত হয় গোটা এলাকা। শুরু হয় নৌকার যাত্রা। গন্তব্য মাঝের খেয়া পর্যন্ত। আবার সেখান থেকে হেলিপ্যাড মাঠে ফেরা। প্রায় তিন কিলোমিটার নদীপথ। বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আন্ধারমানিক নদী উথাল-পাথাল হয়ে ওঠে। নৌকার দাঁড় টানার কসরত ও নৌকা চালানোর কৌশল দিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া লাজারেঞ্জ ফলিয়া মাঝির দল বিজয় ছিনিয়ে নেন। তিনি লতাচাপলী ইউনিয়নের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন। যথাক্রমে দ্বিতীয় হয়েছেন রঞ্জিত বালা। তিনি ধানখালী ইউনিয়নের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তৃতীয় স্থান লাভ করেন কালীপদ বাড়ৈ। তিনি মিঠাগঞ্জ ইউনিয়নের হয়ে বাইচে লড়েছেন। যদিও জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় দূরত্ব থাকে ৬৫০ মিটার। কিন্তু এখানে বাইচের দূরত্ব ছিল দুইবারে আসা যাওয়া মিলে প্রায় ১২ কিলোমিটার। তবে অত্যাধুনিক নৌকার সমারোহে বাইচটি ছিল একটি ব্যতিক্রম ধর্মী উপভোগ্য উৎসব।
কালকিনি থেকে আসা নৌকার মাঝি ও মালিক জুরান হালদার (৬৭) জানান, তিনি ছাড়াও তার এলাকার আরও চারটি নৌকা এসেছে। গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন মাল্লা থাকছে। নৌকার মধ্যে ঢোল-তবলা নিয়ে গায়েনরাও থাকেন। কলাপাড়া দীর্ঘ কয়েক যুগ পরে অনুষ্ঠিত জমজমাট নৌকাবাইচকে ঘিরে ব্যাপক উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নদীর দুই পাড়ে মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হাজারো নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর, যুবরা একটি উপভোগ্য, আমুদে সময় কাটান। এই নৌকাবাইচটি নতুন প্রজন্মের কাছে ছিল কাক্সিক্ষত একটি উৎসব। আর আন্ধারমানিক নদী যেন তার হারানো যৌবনের অতীতকে কিছুটা হলেও ফিরে পেয়েছিল। স্রোতের ধারা না ফিরলেও ফুলে-ফেঁপে উঠছিল বাইচের নৌকার ছুটে চলার মধ্য দিয়ে। ঠিক কত বছর আগে আন্ধার মানিকে নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান মেলেনি। তবে আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন সবাই।
নৌকাবাইচকে উৎসাহ প্রদান ও ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য ফি বছর বাংলাদেশে জাতীয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। কলাপাড়ায় ঐতিহ্যবাহী এ নৌকাবাইচকে ঘিরে দিনভর বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ। আন্ধারমানিক নদীপাড় মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়।