ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৪ মাঘ ১৪৩১

নাঙ্গলকোটে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি, শক্ত অবস্থানে জামায়াত

বেলাল হোসেন রিয়াজ, নিজস্ব সংবাদদাতা, নাঙ্গলকোট, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ১৮:১১, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫; আপডেট: ১৮:৪৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

নাঙ্গলকোটে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত বিএনপি, শক্ত অবস্থানে জামায়াত

বাম দিক থেকে গফুর ভূঁইয়া, ইয়াছিন আরাফাত, মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া, নজির আহম্মেদ ভূঁইয়া

কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে দীর্ঘদিন ধরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।অপরদিকে সাংগঠনিকভাবে মজবুত অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী। দীর্ঘদিন  বিএনপি নাঙ্গলকোটে বিভিন্ন আন্দোলনে সুবিধা করতে না পারলেও ৫ আগস্টের পর বিএনপির তিন গ্রুপের গ্রুপিং আন্দোলন দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। আর এই সুযোগকে জামায়াত কাজে লাগিয়ে তাদের সাংগঠনিক ভীত মজবুতে নাঙ্গলকোটের প্রতিটি অঞ্চলে নিরলস তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি বিএনপির সাবেক এমপি আবদুল গফুর অনুসারী সেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়কের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে নাঙ্গলকোটের গ্রুপিং রাজনীতি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। তাদের স্ব স্ব গ্রুপের  দলীয় প্রভাব বিস্তার করতে প্রায়ই সংঘাতে জড়াচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। একপক্ষ কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলে আরেকপক্ষ পালটা কর্মসূচি ঘোষণা করছে। এই দলাদলি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সর্বশেষ পরিণতি স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে হত্যা।

বিএনপির একটি পক্ষের হামলায় অপর পক্ষের অনুসারী স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সেলিম ভুঁইয়া (৪৫) নিহত হন। তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে বিএনপির এক পক্ষের অভিযোগ। গত শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) বেলা আড়াইটার দিকে উপজেলার বাঙ্গড্ডা বাজার এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। নিহত সেলিম ভূঁইয়া উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ছিলেন।

উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, নাঙ্গলকোটে তিন ভূঁইয়াদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে গ্রুপিং আর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত তাঁদের প্রিয় সংগঠনটি। বর্তমানে তিন ভূঁইয়ার তিনটি পক্ষ নাঙ্গলকোটে পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে পুরোনো দলাদলি ও দ্বন্দ্ব চলছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়ার এবং উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার সাথে।

এছাড়া কয়েক বছর ধরে নাঙ্গলকোটে বিএনপির রাজনীতিতে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজির আহম্মেদ ভূঁইয়াও সক্রিয়। ১লা ফেব্রুয়ারির হামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের নিহত নেতা সেলিম ভূঁইয়া সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়ার অনুসারী। আর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার অনুসারীদের বিরুদ্ধে। 

গফুর ভূঁইয়া ও মোবাশ্বের ভূঁইয়া কুমিল্লা-১০ (নাঙ্গলকোট, লালমাই ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই ভূঁইয়াকে বাদ দিয়ে এ আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী। নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজির আহম্মেদ ভূঁইয়া বর্তমানে মনিরুল হক চৌধুরীর বলয়ে রাজনীতি করছেন। তবে নাঙ্গলকোট বিএনপির রাজনীতিতে এখন মূল আলোচনা গফুর ভূঁইয়া আর মোবাশ্বের ভূঁইয়াকে নিয়েই।

এই ছাড়া জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ নাঙ্গলকোটে গত ১৭ বছরে আত্মগোপন থেকে কাজ করেন। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব পর থেকে নাঙ্গলকোট উপজেলার প্রত্যেক এলাকায় তাদের নেতা কর্মীরা সক্রিয়ভাবে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে এ আসন থেকে জামায়াতের প্রার্থী হিসাবে মাঠে ময়দানে মাওলানা ইয়াছিন আরাফাত উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। জামায়াত নেতাদের দাবি বিএনপিকে টেক্কা দিয়ে এই আসন থেকে জায়াত প্রার্থীকে বিজয়ী করে ঘরে ফিরবেন। তবে পূর্বের চেয়ে বর্তমানে জামায়াত ইসলামী বাংলাদেশ নাঙ্গলকোটে সাংগঠনিক কার্যক্রম মজবুত অবস্থানে রয়েছে। অপরদিকে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সাধারণ মানুষের নিকট দিন দিন গ্রহণ যোগ্যতা হারাতে বসছে বিএনপি।

বিএনপি সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেতা এ কে এম কামরুজ্জামান ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ১৯৯৮ সালে নাঙ্গলকোট বিএনপির হাল ধরেন আবদুল গফুর ভূঁইয়া।

২০০১ সালে বিলুপ্ত হওয়া কুমিল্লা-১১ (নাঙ্গলকোট) আসন থেকে সংসদীয় আসনটি নানা জটিলতা ভুগছে। সেই থেকে নাঙ্গলকোটে বিএনপির রাজনীতিতে ফাটল দেখা দেয়। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রথমে গফুর ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গফুরের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন মোবাশ্বের ভূঁইয়া। তবে ওই নির্বাচনে মোবাশ্বের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পরাজিত হন। এরপরই শুরু হয় দুই ভূঁইয়ার জোরালো গ্রুপিং। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর মোবাশ্বেরকে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন মোবাশ্বের। পরে ২০২২ সালে নজির আহমেদ ভূঁইয়া আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দল চাঙ্গা হয়ে ওঠে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর।

বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোথাও এক পক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করলে আরেক পক্ষও একই স্থানে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। এ ছাড়া প্রায়ই সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন ভূঁইয়াদের অনুসারী বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

এ বিষয়ে সাবেক এমপি আবদুল গফুর ভূঁইয়া বলেন, ‘নাঙ্গলকোটের মানুষ বিএনপি বলতে গফুর ভূঁইয়াকে চেনে। নাঙ্গলকোটে গত ১৭ বছরে আমি মাঠে ছিলাম । আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ভয়ে দল থেকে পদত্যাগ করিনি, নেতা কর্মীদের পাশে ছিলাম। নাঙ্গলকোটের মানুষের একটাই কথা নিজের খাই গফুর ভাই। আমার সাথে যারা নাঙ্গলকোটে রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা নেমেছে  তাদের পায়ের তলায় মাটি নেই। আমার বিশ্বাস নাঙ্গলকোটের মানুষ আমাকে বিএনপি থেকে নির্বাচিত করে নাঙ্গলকোটের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য সংসদে পাঠাবে।  

উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া বলেন, হত্যার বিষয়টি আমার জানা নেই । আমি পরিচ্ছন্ন রাজনীতি পছন্দ করি। আমি রাজনীতি করি মানুষের কল্যাণে। আমি বিএনপির দুঃসময়ে মাঠে ময়দানে ছিলাম আছি ভবিষ্যতেও থাকব। হত্যার রাজনীতি আমি করি না। আমি বিশ্বাস করি সুস্থ ধারার বিএনপির  রাজনীতি  নাঙ্গলকোটে আমি করি। বড় দলের গ্রুপিং থাকবে এটা কোন সমস্যা নয়।

‘নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজির আহম্মেদ ভূঁইয়া বলেন, আমি গত ১৭ বছরে নাঙ্গলকোটে বিএনপির জন্য মাঠে কাজ করে আসছি। সংবিধান মতে বিএনপি নির্বাচন করলে ক্ষমতা আসবে, এটা বুঝতে পেরে কিছু সুবিধাবাদী লোক বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য গায়ে পড়ে আমার সাথে লাগতে আসে তারা আসলে বিএনপির কেউ না। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। তবে বিএনপিতে কোনো গ্রুপিং বলতে কিছু নেই। আমি বর্তমানে নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক। নাঙ্গলকোটের বিএনপি আমার নেতৃত্বে সুসংগঠিত হয়ে ওঠে। যারা মাঠে ময়দানে কাজ করবে জেলা নেতৃবৃন্দ তাদেরকে কমিটি দেবে। যারা দলের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে কাজ করবে তারা কোন কমিটি পাবে পাবেনা।  সেটা বিবেচনা করবে জেলা নেতৃবৃন্দ।  

এই বিষয়ে সাবেক ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইয়াছিন আরাফাত বলেন, সারাদেশে যারা শহীদ হয়েছে তাদের পরিবার নিয়ে জামায়াত ইসলামী নাঙ্গলকোট শাখা কাজ করে যাচ্ছে। নাঙ্গলকোটে আমরা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কথা বলতে পারি নাই। জামায়াত ইসলামী সারাদেশে ৩০০ আসনে নির্বাচন করবে। তারই ধারাবাহিকতা আমি নাঙ্গলকোটে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই সংক্ষিপ্ত সংস্কারের মাধ্যমে সারাদেশে যেন নির্বাচন ব্যবস্থা করা হয়। তার সাথে আমরা আলাদা সংসদীয় আসন ফিরে পাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। এবার নাঙ্গলকোটের মানুষ জামায়াত ইসলামীর আদর্শকে সমর্থন দিচ্ছে। আমরা কুরআন সুন্নাহভিত্তিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করার জন্য মানুষের দোরগোড়ায় আলোর পথে আশার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের দলের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদেরকে এই আসন থেকে বিজয় করার আশ্বাস প্রদান করেন নাঙ্গলকোটের জনগণ।

 

রিয়াজ/সজিব

×