ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

দ্বিতীয় পর্ব শুরু ১৪ ফেব্রুয়ারি

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমা

মোস্তাফিজুর রহমান টিটু/নুরুল ইসলাম, টঙ্গী থেকে

প্রকাশিত: ২৩:৪১, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হলো প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমা

বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপের আখেরি মোনাজাত

এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় ধাপের আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বুধবার শেষ হলো প্রথম পর্বের তবলিগ জামাতের শুরায়ী নেজামের (জুবায়েরপন্থি) ইজতেমা। বুধবার দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে আখেরি মোনাজাত শুরু হয়ে চলে ১২টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত।

টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে বাংলাদেশের শুরায়ে নেজামের শীর্ষ নেতা মাওলানা জুবায়ের আহমেদ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন। প্রায় ৩০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি এ মোনাজাতে অংশ নেন বলে দাবি করেছেন এ পর্বের মুরুব্বিরা।
এ সময় লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমানের কণ্ঠে ‘আমিন আল্লাহুমা আমিন’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীর। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় লাখ লাখ মুসল্লি আকুতি জানান। অনেকে কেঁদে কেঁদে মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা চান। বিশ্ব শান্তির জন্য দোয়া করেন। মোনাজাতে মহান আল্লার কাছে মুসলিম উম্মাহর ঐক্য, শান্তি, সমৃদ্ধি, ইহলৌকিক ও পরলৌকিক মুক্তি এবং দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দেয়ার তৌফিক কামনা করা হয়।

এ সময় দেশের কল্যাণ, মুসলিম উম্মাহর ঐক্য ও বিশ্বশান্তির জন্য কামনা করা হয়। পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে অনুনয়-বিনয় করে জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পানাহ্ ভিক্ষা করছিলেন মুসল্লিরা। 
২০২৬ সালের জানুয়ারিতেও দুই ধাপে হবে শুরায়ী নেজামের ইজতেমা ॥ বিশ^ ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লা রায়হান জানান, এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয় গত ৩১ জানুয়ারি। টানা ৬ দিনব্যাপী এ পর্বের ইজতেমা দুটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয়। বুধবার দ্বিতীয় ধাপের এই আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল তবলিগ জামাতের শুরায়ী নেজামের এবারের বিশ্ব ইজতেমা। 
তিনি আরও জানান, ২০২৬ সালেও শুরায়ী নেজামের অধীনে ওলামায়ে কেরামের তত্ত্বাবধানে ৫৯তম বিশ্ব ইজতেমা দুই ধাপে টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত হবে। ওই বছরের (২০২৬ সাল) প্রথম ধাপের ইজতেমা ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি এবং চারদিন বিরতি দিয়ে ৯, ১০ ও ১১ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।  
শেষ দিনে বয়ানকারী ॥ বিশ^ ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লা রায়হান জানান, বুধবার বিশ্ব তবলিগ জামাতের প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপের শেষদিন ফজরের নামাজের পর ভারতের বেঙ্গালোরের তবলিগের শীর্ষ মুরুব্বি ফারুক সাহেবের বয়ানের মধ্য দিয়ে শেষ দিনের কার্যক্রম শুরু হয়। তাৎক্ষণিকভাবে তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন মুফতি আমানুল হক। এরপর হেদায়াতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান।

তিনি তবলিগের গুরুত্ব তুলে ধরে যারা তবলিগের সফরে আল্লাহর রাস্তায় জামাতে বের হবেন সেসব মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে দিক নির্দেশনামূলক হেদায়তি বয়ান করেন। তার বয়ান বাংলায় অনুবাদ করেন বাংলাদেশের মাওলানা আব্দুল মতিন। এ সময় ইজতেমাস্থলে আগতরা বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়ে সেসব বয়ান শুনেন। তার বয়ানের পর গুরুত্বপূর্ণ নসিহত পেশ করেন ভারতের মাওলানা ইব্রাহীম দেওলা। এরপর দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে দ্বিতীয় ধাপের আখেরি মোনাজাত শুরু হয়ে ১২টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত চলে। 
মোনাজাত ॥ এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপের শেষদিন বুধবার বিশ্ব তবলিগ জামাতের শুরায়ী নেজামের বাংলাদেশের শীর্ষ মুরুব্বি মাওলানা মোহাম্মদ জুবায়ের ছোট ছোট বাক্যে আরবি-উর্দু ও বাংলা ভাষায় প্রায় ১৯ মিনিটব্যাপী আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করেন। তিনি দুপুর ১২টা ৮ মিনিট থেকে মোনাজাত শুরু করেন এবং তা চলে ১২টা ২৭ মিনিট পর্যন্ত।

পবিত্র কোরআনের আরবি আয়াত এবং বাংলা ও উর্দু ভাষায় প্রায় ১৯ মিনিটব্যাপী মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোনাজাত শুরু হতেই পুরো এলাকাজুড়ে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। যে যেখানে ছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে কিংবা বসে হাত তোলেন আল্লাহর দরবারে। খানিক পর পর শুধু ভেসে আসে আমিন, ছুম্মা আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন।

অনুতপ্ত মানুষের কান্নার আওয়াজে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। জীবনের সব পাপ-তাপ থেকে মুক্তির জন্য, পরম দয়াময় আল্লাহর দরবারে কেঁদে কেঁদে অনুনয়-বিনয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভে পানাহ ভিক্ষা করছিলেন তারা। 
দ্বিতীয় পর্বে সাদপন্থির ইজতেমা শুরু ১৪ ফেব্রুয়ারি ॥ এদিকে আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা। তিন দিনব্যাপী এ পর্বের ইজতেমা চলবে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এদিন আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে শেষ হবে এবারের ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমা। মাওলানা সা’দ কান্ধলভী অনুসারী ওয়াসেকুল ইসলামের তবলিগ অনুসারীরা শর্তসাপেক্ষে এ পর্বের ইজতেমায় অংশ নিবেন। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শেষ আগামী ১৮ ফেব্রুয়ারি বাদ মাগরিব মাওলানা সাদ অনুসারীগণ ইজতেমা ময়দান প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করবেন।

এরপর ২০ ফেব্রুয়ারি ইজতেমা ময়দান শুরায়ী নেজামের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তবে আগামী বছর থেকে মাওলানা সা’দ অনুসারীরা টঙ্গীর ময়দানে ইজতেমা করতে পারবে না বলে গত ৪ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়। এরআগে শুরায়ী নেজামের ইজতেমা শেষ হওয়ার পর আজ বৃহস্পতিবার প্রশাসনের কাছে ময়দান হস্তান্তর করা হবে।
জানা গেছে, ইজতেমা ময়দানে সাদপন্থিদের জোড় ইজতেমা করতে না দেওয়ার ঘোষণায় গত ১৮ ডিসেম্বর ভোররাতে ইজতেমা ময়দানে হামলা ও সংঘর্ষে ৪ মুসল্লি নিহত এবং শতাধিক আহত হন। এ নিয়ে দু’গ্রপের সংঘাত আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে। এই পরিস্থিতিতে মারমুখী অবস্থানে চলে যায় উভয়পক্ষই। শুরায়ী নেজামের (মাওলানা জুবায়ের) পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয় টঙ্গীতে সাদপন্থিদের বিশ্ব ইজতেমা করতে না দেওয়ার।

সাদপন্থিরা যাতে নির্ধারিত তারিখে ইজতেমা করতে না পারে সেজন্য শুরায়ে নেজাম দু’ধাপে একটানা ৬ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠান করার ঘোষণা দিলে সাদপন্থিরাও ঘোষণা দেয় তারা ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করবে। তবলিগ জামাতের বিবদমান দুই গ্রুপের এমন পাল্লাপাল্লিতে এবার বিশ্ব ইজতেমা মোট ৩ ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। 
আরও ২ মুসল্লির মৃত্যু ॥ বিশ^ ইজতেমার প্রথম পর্বের মিডিয়া সমন্বয়ক মো. হাবিবুল্লা রায়হান জানান, ইজতেমার প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপে আগত আরো দুই মুসল্লি মঙ্গলবার দিবাগত মধ্যরাতে মারা গেছেন। তারা হলেন- সিরাজগঞ্জের শাহবাজপুর থানার রসুলপুর গ্রামের গফুর আলী সরকারের ছেলে সুজাবত আলী সরকার (৭৫) এবং জয়পুরহাটের আক্কেলপুর থানার রায়কালী এলাকার সামসুল হক (৬০)।

এ নিয়ে বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বে যোগ দিতে আসা মোট ৯ জন মুসল্লি হৃদরোগ, ঠান্ডা ও বার্ধক্যজনিত কারণে ইজতেমা ময়দানে মারা গেছেন। এরমধ্যে প্রথম ধাপে ৫ জন ও দ্বিতীয় ধাপে ৪ জনের মৃত্যু হয়। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ইজতেমার প্রথম পর্বে আগত মোট ১১ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
প্রথমবারের মতো বন্ধ করা হয়নি গণপরিবহন চলাচল ॥ স্মরণকালের মধ্যে এবারই প্রথম টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে আখেরি মোনাজাতের দিন টঙ্গী হয়ে চলাচলকারী সকল সড়ক মহাসড়কে গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক রাখা হয়েছিল। বন্ধ করা হয়নি অন্য ইজতেমাগুলোর মতো আগের রাত থেকে আখেরি মোনাজাতের দিন পর্যন্ত সড়ক মহাসড়কে যানবাহন চলাচল।

টঙ্গী হয়ে সড়ক মহাসড়কগুলোতে গণপরিবহনসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি না করায় যানবাহন চলাচল আখেরি মোনাজাতের দিন স্বাভাবিক ছিল। এতে রাজধানী ঢাকা থেকে উত্তরবঙ্গগামী সকল প্রকার গণপরিবহন চলাচল স্বাভাবিক থাকায় মানুষের মাঝে স্বস্তি ফিরে আসে। মুসল্লিরা নির্বিঘেœ চলাচল ও গন্তব্যে যেতে পেরেছে।
দ্বিতীয় পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় মুসল্লিদের চাপ কম থাকায় টঙ্গীর সড়ক মহাসড়কে ট্রাফিক জ্যাম তেমন ছিল না বললেই চলে। সড়ক পথে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. নাজমুল করিম খান তবলিগ জামাতের বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাতের দিন যানবাহন চলাচলের ওপর প্রচলিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ায় যাত্রী, চালক ও সাধারণ মানুষ ছিলেন বেশ খুশি।
প্রথম পর্বে দু’সহ¯্রাধিক জামাত তৈরি ॥ বিশ্ব ইজতেমার আয়োজক কমিটি সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন দেশে তবলিগের কাজে বের হতে শুরায়ী নেজামের এবারের ইজতেমা স্থলে চার সহ¯্রাধিক জামাত তৈরি হয়েছে। দেশীয় বিদেশী এসব জামাতে কেউ কেউ এক চিল্লা, দু’চিল্লা, তিন চিল্লা, ছয় চিল্লা ও এক বছরের চিল্লা এমনকি আজীবন চিল্লার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। আগামী ১৫-২০ দিনে মধ্যে এসব জামাত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে।
মোনাজাতে মহিলাদের অংশগ্রহণ ॥ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত বিপুলসংখ্যক নারী। ইজতেমায় নারীদের অংশ নেওয়ার বিধান না থাকলেও এসব নারীদের অধিকাংশই আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আগের দিন রাত থেকে ইজতেমা ময়দানের আশপাশে, বিভিন্ন মিলকারখানা, বাসা-বাড়িতে ও বিভিন্ন দালানের ছাদে অবস্থান নেন।

এ ছাড়াও ভোর থেকে নারীরা ইজতেমা ময়দান সংলগ্ন শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের মাঠ, ইজতেমা মাঠের পশ্চিম পাশে কামারপাড়া ও আশপাশের খোলা ময়দানে অবস্থান নেন। তারা স্ব-স্ব অবস্থানে বসে আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

×