খুলনা বিভাগীয় প্রশাসনের আয়োজনে বুধবার রূপসা নদীতে অনুষ্ঠিত হয় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ
ঘড়ির কাঁটায় বেলা ১টা, খুলনার রূপসা নদীর ১নং কাস্টম ঘাট এলাকায় একে একে দাঁড়িয়ে সাতটি নৌকা। কোনো নৌকায় ৫০ জন আবার কোনোটিতে ১০০ জনের ওপরে বৈঠা হাতে অপেক্ষা করছেন। পিছনে এক জন দাঁড়িয়ে আছেন হাল ধরে। দুই এক জনকে দেখা গেল কাঁসর-বাঁশি আর ঝাঁজর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। এরপর মাইকের মাধ্যমে ঘোষণা। হেইয়ো মেরে শুরু হলো চলা। গন্তব্য খানজাহান আলী সেতু (রূপসা সেতু) পর্যন্ত।
ছলাত ছলাত পানির শব্দ আর বাজনার তালে তালে বৈঠা মেরে এগিয়ে যাচ্ছে নৌকা। দর্শক বাঁধভাঙা চিৎকার আর করতালির উৎসাহে মাঝিরা যেন আরও সবল হয়ে দূরন্ত গতিতে নৌকা এগিয়ে নেয় সামনের দিকে। ঢেউয়ের কলতান, হেইয়োরে হেইয়ো আর সারিবদ্ধ বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দে উত্তাল হয়ে উঠে খুলনার শান্ত রূপসা নদী। শীতের মিষ্টি রৌদে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ উপভোগ করে খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ। তবে মাত্র একবার বাইচ হওয়ায় হতাশ হয়েছেন অনেক দর্শক।
খুলনা মহানগরী ঘেঁষা রূপসা নদীর দুই পাড়ে নেমেছিল মানুষের ঢল। এক থেকে শত, শত থেকে হাজারো অথবা হাজার ছাপিয়ে লক্ষ মানুষের ভিড় জমেছিল উচ্ছ্বল, উদ্দীপনা, বিনোদনে পরিণত হওয়া এই নৌকা বাইচের মনোমুগ্ধকর প্রতিযোগিতা দেখতে। নদীর দুই পাড়ের বিভিন্ন ঘাট, জেটি, থেমে থাকা লঞ্চ-কার্গো-জাহাজ, উঁচু ভবনের ছাদ সবখানেই ছিল জনারণ্য।
এ ছাড়া ট্রলার, নৌকা, স্প্রিটবোটসহ বিভিন্ন নৌযানের সংখ্যাও কম ছিল না। কেউ বা চেয়ারে বসে, কেউবা পাড়ের মাটিতে বসে, আবার কেউবা দাঁড়িয়ে থেকে পুরো প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন পরম উৎসাহভরে। বাইচের উত্তেজনা ছাপিয়ে এ যেন মানুষের এক মহামিলনমেলা।
তারুণ্যের উৎসব-২০২৫ উদযাপনের অংশ হিসেবে বুধবার দুপুরে অনুষ্ঠিত হয় নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা। খুলনা বিভাগীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় গোটা আয়োজন। এর আগে বেলা ১১টায় নৌকা বাইচ উপলক্ষে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা নগরীর শহীদ হাদিস পার্ক থেকে শুরু হয়ে ১ নম্বর কাস্টমস ঘাটে গিয়ে শেষ হয়।
সেখানে বেলুন ও ফেস্টুন উড়িয়ে বাইচের উদ্বোধন করেন অতিথিরা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী। বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) সুরাইয়া আক্তার জাহান, খুলনা রেঞ্জ ডিআইজি মো. রেজাউল হক, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার ও খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে যুব ও ক্রীড়া সচিব জানান, নৌকা বাইচ গ্রাম বাংলার একটি ঐতিহ্য। এরই ধারাবাহিকতায় উৎসবমুখর পরিবেশে খুলনাবাসীকে নির্মল বিনোদন উপভোগের সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ার লক্ষ্যে আমরা তারুণ্যের উৎসব উদযাপন করছি। আমরা চাচ্ছি তারুণ্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন করে বাংলাদেশটাকে সাজাতে, যেখানে সহযোগিতার নীতি প্রচার করা হবে।
বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার বলেন, তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রেখে উৎপাদনশীল কাজের সঙ্গে যুক্ত রাখতে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন। তিনি আরও জানান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সাতটি নৌকা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এই ধরনের আয়োজন নতুন প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে এবং আগামীতে আয়োজন অব্যাহত থাকবে।
সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী দিলরুরা খানম বলেন, আমি এই প্রথম নৌকাবাইচ দেখলাম। আমি এতোগুলো নৌকা ও এতো বড় নৌকা আগে কখনো দেখিনি। আমার খুবই ভালো লেগেছে। সামনের বছর নৌকাবাইচ হলে আমি আবার দেখতে আসব। হাজার হাজার মানুষ দেখেও আমার ভালো লেগেছে।
গৃহবধূ বিলকিস সুলতানা বলেন, আমি আমার ছেলে মেয়ে, শ্বশুর, শাশুড়িকে নিয়ে নৌকাবাইচ দেখতে এসেছি।
এর আগেও আমি কয়েকবার দেখেছি। ভালো লাগে বিধায় বার বার আসি। তিনি আরও বলেন পরিবারের সকলকে এটা দেখা উচিত; বিশেষ করে শিশুদের। তা না হলে আগামীতে আমাদের শিশুরা ভুলেই যাবে যে, নৌকা এক সময় আমাদের প্রধান যানবাহন ছিল। তবে একবার বাইচ হওয়াতে হতাশ হয়েছি।
আর হরসিৎ মজুমদার বলেন, আমার বাবাও বাইচ করত। তবে আমার ছেলে করবে কিনা জানি না। মানুষের ইচ্ছাশক্তি কমার পাশাপাশি নদ-নদীও মরে যাচ্ছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে নৌকার সংখ্যাও। সারা বছর এক দুইটা প্রতিযোগিতার পর নৌকা ব্যবস্থাপনাও কঠিন হয়ে পড়ে। নৌকা বানানোর লোকও হাতে গোনা হয়ে যাচ্ছে।
নৌকা চালক রবিউল হাসান বলেন, বাড়িতে অনেক কাজ ফেলে রেখে এসেছি। এসে অন্যেদের যেমন আনন্দ দিই নিজেরাও ঠিক তেমন আনন্দ পাই। তবে আগের মতো এখন আর বাইচ হয় না। এ বিষয়টি সরকারের দেখা প্রয়োজন। আর এখানে একবার বাইচ হয়েছে। ২/৩ বার হলে আরও ভালো লাগত।
নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে কয়রার সুন্দরবন টাইগার্স নামক নৌকাবাইচ দল, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয় জয় মা কালী ও মোবাইল নামের নৌকাবাইচের দল। প্রথম স্থান অর্জনকারী দলকে ৭৫ হাজার টাকা, দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী দলকে ৫০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় স্থান অর্জনকারী দলকে ৩০ হাজার টাকা পুরস্কার হিসেবে প্রদান করা হয়।
জানা যায়, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিযোগিতার সময় ডুবুরি দল ও অ্যাম্বুলেন্সসহ ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা প্রস্তুত ছিল। এছাড়া নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বাংলাদেশ নৌ বাহিনী, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশেরও সজাগ দৃষ্টি ছিল।